চীনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি

SHARE

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দেয়া চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াংয়ের মৃত্যুর পর চীনে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তরুণ এই চিকিৎসকের মৃত্যুর পর দেশটিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক সংস্কারের বিরল দাবি জোরালো হয়ে উঠছে।

গত ৩০ ডিসেম্বর চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ব্যক্তিগত উইচ্যাট গ্রুপে বন্ধুদের সতর্ক করে দিয়ে লি বলেন, ‘উহানের হাসপাতালে সার্স ভাইরাসে সাতজন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু পরে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এটি অজ্ঞাত এক করোনাভাইরাস।’

উইচ্যাটের ব্যক্তিগত সেই গ্রুপে চিকিৎসক বন্ধুদের সঙ্গে লির এ আলোচনার একটি স্ক্রিনশট ফাঁস হলে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ এনে চিকিৎসক লিকে উহানের একটি পুলিশ স্টেশনে মধ্যরাতে ডেকে তীব্র ভর্ৎসনা করা হয় ও সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে তাকে চুপ থাকার নির্দেশ দেয়া হয়।

এরপর গত বৃহস্পতিবার রাতে নিজেও করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা যান লি। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের চিকিৎসা দিতে গিয়ে নিজেই সংক্রমিত হয়ে প্রাণ হারানো এই চিকিৎসককে চীনারা এখন জাতীয় বীরের খেতাবে ভূষিত করেছেন।

নতুন ও অজানা প্রাণঘাতি ভাইরাসের আক্রমণের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়ার ঘটনায় কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো লির মুখ বন্ধ করে দেয়ার ঘটনায় দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকারের কঠোর সমালোচনা করছেন চীনা নাগরিকরা।

ফরাসী বার্তাসংস্থা এএফপি বলছে, এই ভাইরাসের উপস্থিতির ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়ার কারণে শুধুমাত্র লি ওয়েনলিয়াং নন; তার আট চিকিৎসক বন্ধুকেও গুজব ছড়ানোর অভিযোগে শাস্তি দিয়েছিল উহান পুলিশ। লির মৃত্যু দেশটির সামষ্টিক স্নায়ুতে এক ধরনের আঘাত করেছে। শনিবার চীনের বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদ আরও বেশি মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন।

বাক স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে দেশটির শিক্ষাবিদদের দেয়া অন্তত দুটি বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ৩৪ বছর বয়সী চিকিৎসক লির মৃত্যুর পর ছড়িয়ে পড়া এ দুই বিবৃতির মধ্যে একটিতে উহানের অন্তত ১০ অধ্যাপকের স্বাক্ষর রয়েছে।

চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইবোতে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, লি দেশ এবং সমাজের স্বার্থ রক্ষায় চেষ্টা করেছিলেন। চিঠিতে বাক-স্বাধীনতার নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছেন চীনা অধ্যাপকরা। একই সঙ্গে ডিসেম্বরের শেষের দিকে করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ে আলোচনার কারণে লি ও অন্য সাত চিকিৎসককে শাস্তি দেয়ার ঘটনায় চীন সরকারকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।

অন্যদিকে, শুক্রবার বেইজিংয়ের বিখ্যাত সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের একটি গ্রুপ নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারের নিশ্চিয়তার দাবি জানিয়ে খোলা চিঠি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার বিরোধিতা করুন- এটি একটি ক্ষুদ্র সংস্থার অত্যন্ত স্বার্থপর লক্ষ্য।

চীনের রাজনৈতিক সংস্কারে বিরল এক আহ্বান জানানো হয়েছে এ দুই চিঠিতে। দেশটিতে সরকারের সমালোচনার কারণে প্রায়ই সমালোচকদের গুম অথবা কারাবন্দি করে রাখা হয়। তবে রোববার অনেকেই উইবোতে অভিযোগ করে বলেছেন যে, রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি জানিয়ে শিক্ষাবিদদের দেয়া এ দুই চিঠি উইবো থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

এদিকে, এই ভাইরাসের উপস্থিতির ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়ার কারণে উহান পুলিশ লি ওয়েনলিয়াংয়ের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করেছিল; তার নিন্দা জানিয়েছেন এই চিকিৎসকের মা। পিয়ার ভিডিওতে প্রকাশিত একটি ফুটেজে দেখা যায়, লির মা বলছেন, ‘আমার ছেলে এই ভাইরাসের ব্যাপারে আগে সতর্ক করে দেয়ার কারণে আমাদের পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। ভুল তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ এনে সেখানে একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয় লিকে। ভাইরাসের উপস্থিতি নিয়ে লি সতর্ক করে দিলেও সে ব্যাপারে কোনো তদন্ত না করেই এ ধরনের হেনস্তা করা হয়েছিল।’

তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্ত না করেই মধ্যরাতে উহান পুলিশ স্টেশনে তাকে ডেকে পাঠানো হয়। তারা যদি এর সঠিক ব্যাখ্যা না দেয়, তাহলে আমরা শান্ত হবো না।

গত ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানের একটি সামুদ্রিক খাবারের বাজার থেকে চীন সহ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৩৭ হাজার ৪৬৩ জন। এ ভাইরাসে মারা গেছেন ৮১৩ জন এবং সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেছেন ২ হাজার ১৫২ জন।

সূত্র : এএফপি, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট