ধর্ষক জঙ্গির মুখোমুখি ইয়াজিদি তরুণী, এরপর…

SHARE

ইরাকের একটি টেলিভিশন চ্যানেল এক আইএস জঙ্গি ও তার হাতে ধর্ষণের শিকার এক ইয়াজিদি নারীকে তাদের একটি শোতে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো। এরপর ওই নারী সেই ধর্ষক জঙ্গির ওপর নিজের ক্ষোভ ঝাড়েন। সে তার জীবনের যে সর্বনাশ করেছে এবং তাকে যে বেদনার সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে সে কথা শোনায়। কিন্তু ওই নারী নিজের বেদনার কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যান।

এ ঘটনায় আল-ইরাকিয়া নামের ওই টেলিভিশন চ্যানেলের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

আসওয়াক হাজি হামিদ নামের ওই নারীর বয়স যখন মাত্র ১৪ বছর তখন তাকে ইরাকের সিঞ্জার পাহাড় এলাকার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় আইএস জঙ্গিরা। ২০১৪ সালের ওই সময়ে আরো হাজার-হাজার ইয়াজিদি নারীকে অপহরণ করা হয়েছিলো।

আসওয়াক হাজি হামিদকে তুলে দেওয়া হয় মোহাম্মদ রাশিদ নামের এক জিহাদির হাতে। যে তাকে হাতকড়া পরিয়ে বারবার ধর্ষণ করে।

তবে এক পর্যায়ে আসওয়াক এবং আরো কয়েকজন ইয়াজিদি নারী জঙ্গিদের আস্তানা থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এরপর আসওয়াক ইরাক ছেড়ে জার্মানিতে গিয়ে আশ্রয় নেন। ওদিকে তাকে ধর্ষণকারী ওই জঙ্গিও ঘটনাক্রমে জার্মানিতে গিয়ে হাজির হয়। ২০১৮ সালে একদিন রাস্তায় তাকে ধর্ষণকারী ওই জঙ্গিকে দেখতে পেয়ে ক্ষোভে তেড়ে গিয়েছিলেন আসওয়াক।

গত মাসে আসওয়াক ফের ওই জঙ্গির মুখোমুখি হন আল-ইরাকিয়া টিভি চ্যানেলের একটি স্পেশাল নিউজ রিপোর্ট শো-তে। ধর্ষক রাশিদ ইরাকের কারাগারে বন্দি ছিলেন। সেখান থেকেই তাকে কয়েদির পোশাকে টিভি শোতে আসওয়াক হাজি হামিদের সামনে হাজির করা হয়। এবং তাকে তার হাতে ধর্ষণের শিকার ওই নারীর বেদনার কথা শুনতে বাধ্য করা হয়।

ধর্ষকের মুখোমুখি হয়ে নিজের ক্ষোভ ঝাড়ছিলেন আসওয়াক। বর্তমানে ১৯ বছর বয়সী ওই তরুণী ধর্ষককে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তুমি আমার জীবনটাই ধ্বংস করে দিয়েছো। তুমি আমার সব স্বপ্ন ধ্বংস করে দিয়েছো।’ ধর্ষককে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে আদেশ করে ওই তরুণী বলেন, ‘আমার দিকে তাকাও। তোমার কি কোনো অনুভুতি নেই? তোমার কি কোনো সম্মান নেই? আমার বয়স ছিলো মাত্র ১৪ বছর। হয়তো তোমার মেয়ে, ছেলে বা বোনের বয়সী ছিলাম আমি।’

এভাবে ধর্ষকের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়ার এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ওই তরুণী।

এই ঘটনায় মানসিক ট্রমা বিশেষজ্ঞরা টিভি চ্যানেলটির সমালোচনায় মেতে উঠেছেন। কারণ তারা আগেই সাবধান করেছিলেন, এতে করে ওই নির্যাতিতা নারীর মনে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিলো তা আবারো উম্মুক্ত হয়ে পড়তে পারে এবং ভয়ানক কিছু ঘটতে পারে।

ইয়াজিদি নারীদের মানসিক চিকিৎসা দিতেন কুর্দি-জার্মান বংশোদ্ভুত ডা. জান ইলহান কিজিলহান। তিনি বলেন, ‘কোনো ধর্ষিতা নারীকে এভাবে ধর্ষকের মুখোমুখি করাটা পুরোপুরি চিকিৎসা বিজ্ঞানবিরোধী আচরণ।’

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এবং মানবাধিকার কর্মী ইয়াজিদী নারী নিবরাস খুদাইদা বলেন, ‘এটা খুবই বাজে একটা কাজ হয়েছে। আর ওই নারী এখনো মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেননি। তার মধ্যেই তাকে ধর্ষকের মুখোমুখি করাটা ঠিক হয়নি। পুরুষরা কবে বুঝবে কীভাবে এমন একজন নির্যাতিতা নারীকে নিয়ে নাড়া-চাড়া করতে হয়?’

এদিকে ওই টেলিভিশন শো’র ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। এরপর এক কুর্দি টিভি চ্যানেল ধর্ষিতা তরুণী আসওয়াক হামিদকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘ওই ধর্ষকের মুখোমুখি হয়ে নিজের ক্ষোভ ঝাড়তে পেরে আমি খুশি হয়েছি। তাকে সামনে পেয়ে গত পাঁচ বছর ধরে আমার মনে যে তীব্র অসন্তোষ জমা হয়ে ছিলো তা ঝেড়ে দিয়েছি।’ তবে ধর্ষককে দেখে তরুণীর মনে পুরোনো ভয়ও ফিরে আসে। আসওয়াক বলেন, ‘তাকে দেখার পর আমার মনে এই ভয় কাজ করছিলো সে হয়তো আবারো আমাকে জোরপূর্বক যৌনদাসী বানাবে।’

সম্প্রতি ইরাকে ধর্ষক-ধর্ষিতার এই ধরনের মুখোমুখি টিভি শো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই ধরনের মুখোমুখি সাক্ষাতের বিষয়টিকে নির্যাতিতা নারীদের জন্য মানসিক স্বান্তনার সুযোগ সৃষ্টিকারী হিসেবে বিবেচনা করছেন অনেকে। কেননা তারা এর মধ্য দিয়ে নিজের চোখে ন্যায়বিচার দেখার করার সুযোগ পাবে।

তবে সমালোচকরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে বরং নির্যাতিতা নারীদেরকে আরো অসম্মান করা হচ্ছে। এবং এর মধ্য দিয়ে তাদের মনের পুরোনো ক্ষতই বরং আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।

বিবিসির সাংবাদিক স্ট্যাসি ডুলেও একবার এমন এক আইএস জঙ্গি ও ধর্ষিতা ইয়াজিদি নারীকে মুখোমুখি করে সমালোচানার মুখে পড়েছিলেন। টিভি শোতে ওই আইএস কমান্ডার ২০০-রও বেশি নারীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন।