পাহাড়ধস কেড়ে নিল ১১৭ প্রাণ

SHARE

প্রবল বর্ষণে পাহাড়ধসে সেনাবাহিনীর চারজন সদস্যসহ ১১৭ জন নিহত হয়েছেন। গতকাল সোমবার রাত ও আজ মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও বান্দরবানে পাহাড়ধসের ঘটনায় এ প্রাণহানি হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ২১ জন ও চন্দনাইশে ৩ জন, রাঙামাটিতে ৪ সেনাসদস্যসহ ৮৯ জন এবং বান্দরবানে ৪ জন নিহত হয়েছেন।

পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর পাহাড়ধসে হতাহত ব্যক্তিদের সমবেদনা জানাতে ও ক্ষয়ক্ষতি দেখতে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল আগামীকাল বুধবার রাঙামাটি যাচ্ছে।

রাঙ্গুনিয়া : উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামাল হোসেন জানান, জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রাজানগর ও ইসলামপুর ইউনিয়নে আজ পাহাড়ধসের ঘটনায় চার পরিবারের ১৯ জনসহ ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার রাজানগর ও ইসলামপুর ইউনিয়নের চার স্থানে প্রবল বর্ষণে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এতে রাজানগর ইউনিয়নের বগাবিলী টাইক্যা ঘোনা এলাকায় বসতঘর চাপা পড়ে নজরুল ইসলাম (৪০), তাঁর স্ত্রী আসমা আকতার বাচু (৩৫), ছেলে ননাইয়া (১৫) ও মেয়ে সাথী আকতার (৯) মারা যায়। একই ইউনিয়নের বালুখালী এলাকার মো. ইসমাইল (৪২), তাঁর স্ত্রী মনিরা খাতুন (৩৭), মেয়ে ইশামনি (৮) ও ইভামনি (৪) পাহাড়ধসে মারা যায়। এ ছাড়া ইসলামপুর ইউনিয়নে মইন্যার টেক এলাকার মো. সুজন (৪২), তাঁর স্ত্রী মুন্নী আকতার (২৪), সুজনের তিন বোন জ্যোৎসনা আকতার (১৮), শাহনুর আকতার (১৬) ও পালুমা আকতার (১৪) মাটিচাপা পড়ে নিহত হন। একই ইউনিয়নের পাহাড়তলী ঘোনা এলাকার হেঞ্জু মিয়ার স্ত্রী শেফালী বেগম (৪৯), মো. হানিফের ছেলে মো. হোসেন (২২), বাচ্চু মিয়ার ছেলে মো. পারভেজ (১৮), মো. সিদ্দিকের স্ত্রী রিজিয়া বেগম (৪৫), মফিজুর রহমানের মেয়ে মুনমুন আকতার (১৯) ও ছেলে হিরু মিয়া (১৬) পাহাড় ধসে প্রাণ হারান। বাকি দুজনের নাম জানা যায়নি।

চন্দনাইশ: ইউএনও লুৎফর রহমান বলেন, পাহাড়ধসে গতকাল রাত দুইটার দিকে চন্দনাইশ উপজেলার চাইহ্লাউ খেয়াংয়ের বাড়ির ওপর পাহাড় ধসে পড়ে। এ সময় চাইহ্লা উ খেয়াংয়ের মা মকাংঞো খেয়াং (৬০), ছেলে ক্যসা খেয়াং (৭) ও তাঁদের বাড়িতে বেড়াতে আসা ভাগনি ম্যাম্রাউ (১৪) মাটি চাপায় মারা যান। ক্যসা খেয়াং দ্বিতীয় শ্রেণিতে ও ম্যাম্রাউ অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। চাইহ্লা উ খেয়াং ও তাঁর মেয়ে সানু খেয়াংকে মারাত্মক আহত অবস্থায় বান্দরবান সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

রাঙামাটি : অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) প্রকাশ কান্তি চৌধুরী জানান, দুই দিনে পাহাড়ধসে সেনাসদস্যসহ ৮৯ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে রাঙামাটি সদরে ৪৫ জন, কাউখালীতে ২৩ জন, কাপ্তাইয়ে ১৬ জন, বিলাইছড়িতে ৩ জন ও জোড়াছড়িতে ২ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক রাশিদুল হাসান প্রথম আলোকে জানান, পাহাড়ধসে সেনাবাহিনীর চার সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা উদ্ধারকাজে গিয়েছিলেন। তাঁরা হলেন মেজর মাহফুজ, ক্যাপ্টেন তানভীর, করপেরাল আজিজ ও সৈনিক শাহীন। ১০ জন সেনাসদস্যকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে, একজন সেনাসদস্য নিখোঁজ রয়েছেন। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক আজ বিকেলে ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ পরিদর্শন করেন।

বান্দরবান : দুই দিনের টানা ভারী বৃষ্টিপাতে পাহাড়ধসে জেলায় চারজন নিহত, দুজন নিখোঁজ এবং ছয়জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজনকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বান্দরবান জেলা শহরের কালাঘাটায় এবং শহরতলির লেমুঝিরিপাড়া ও লেমুঝিরি আগাপাড়া এলাকায় বাসাবাড়িতে পাহাড় ধসে পড়ে। এ সময় লেমুঝিরিপাড়ায় একই পরিবারের ঘুমন্ত তিন শিশু ও কালাঘাটায় একজন কলেজছাত্র নিহত হয়েছেন।
লেমুঝিরিপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত স্বপন বড়ুয়ার বাড়িতে পাহাড়ের একাংশ ধসে পড়ে। স্বপন বড়ুয়ার বাড়িটি কাদা আকারে নেমে আসা পাহাড়ের মাটির সঙ্গে একেবারে মিশে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। প্রতিবেশী সুমন বড়ুয়া বলেন, গতকাল রাত তিনটার দিকে ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি বাড়িতে ঢুকতে থাকে। তখন স্বপন বড়ুয়া ও তাঁর স্ত্রী বাড়ির নালায় পানি সরানোর জন্য বের হয়েছিলেন। তাঁদের তিন শিশুসন্তান ঘুমিয়ে ছিল। এ সময় বিকট আওয়াজে পাহাড়টি বাড়িতে ঘুমন্ত শিশুদের ওপর পড়ে। প্রতিবেশীরা কাদা সরিয়ে সেতু বড়ুয়া (১০), হৃদয় বড়ুয়া (৭) ও লতা বড়ুয়াকে (৩) উদ্ধারের চেষ্টা করেন। পরে মৃত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করা হয়। সন্তানদের উদ্ধার করতে গিয়ে আহত হন স্বপন বড়ুয়া নিজেও।
গতকাল রাত একটার দিকে জেলা শহরের কালাঘাটায় একটি বাসায় পাহাড় ধসে পড়ে। এতে ঘুমন্ত অবস্থায় রেভা ত্রিপুরা (২২) নামের একজন কলেজছাত্র মাটিচাপা পড়ে মারা যান।
বান্দরবান সদর থানার উপপরিদর্শক মোহাম্মদ বেলাল জানিয়েছেন, বান্দরবানে নিহত চারজনের মরদেহ সৎকারের জন্য আত্মীয়দের কাছে দেওয়া হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
বাসস জানায়, পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ পৃথক বার্তায় চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও বান্দরবানে বেসামরিক জনগণ এবং হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধারকাজে নিয়োজিত কয়েকজন সেনাসদস্যের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন তাঁরা।
রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন বলেন, রাষ্ট্রপতি সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে উদ্ধার অভিযান শেষ ও আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। তিনি নিহত ব্যক্তিদের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভূমিধসে প্রাণহানিতে গভীর শোক প্রকাশ করে নিহত ব্যক্তিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁদের শোকাহত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। তিনি ভূমিধসে আটকে পড়া মানুষের দ্রুত উদ্ধার ও তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।