রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবের মোড়ে ধানমন্ডি ১ নম্বর সড়কের এক পাশে সারি বেঁধে বসে আছেন বেশ কয়েকজন। এঁদের একজন সালাম মিয়া বারবার উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন। রাস্তাটি দিয়ে চলাচল করছে রিকশা। দু-একটি রিকশার কাছে গিয়ে ফিরে এসে সালাম মিয়া অন্যদের বলেন, ‘বিয়ালে বাইরন উচিত আছিল। রৌদের মইধ্যে মাইনসে মার্কেটে কম আইতাছে। গরমে ভিক্ষা কইরাও শান্তি নাই।’
ঈদ-রোজা এলেই রাজধানীতে ভিক্ষুক বেড়ে যায়। বাড়তি কিছু আয়ের আশায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকেই এক মাসের জন্য ঢাকায় চলে আসেন। সালাম মিয়ার বাড়ি ফরিদপুরে। সেখানে তিনি দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। ঢাকায় এসেছেন গত মাসে। তিনি বলেন, ‘দ্যাশে কাম-কাজ নাই। তিন বছর ধইরা রোজায় এহানে আইয়া পড়ি। বড়লোকরা থাহে। আর এই মাসে হেরা দানখয়রাতও বেশি দেয়।’ সালাম ঈদের পরদিন বাড়ি যাবেন। অনেক বাড়িতেই ঈদের দিন টাকাপয়সা দেবে। সে আশায় ঈদে থাকবেন। এই সময়টাতে ১৫-২০ হাজার টাকা আয় করেন।
বৃষ্টি ছোট থেকেই সায়েন্স ল্যাবে ভিক্ষা করেন। এ পথে যাতায়াতকারী সবাই তাঁকে চেনে। আয় খারাপ না। কিন্তু ঈদ এলেই তাঁর প্রতিযোগী বেড়ে যায়। কিছুটা মন খারাপ করেই বললেন, ‘এইহানের বেশির ভাগই বরিশাল আর ফরিদপুর থেইকা আহে। মানুষ কয়জনরে ভিক্ষা দিব? আমরা চার-পাঁচজন সব সময় থাকি। অহন ১৫ জনের মতো আছি এই রাস্তায়।’
বিপণিবিতান কেন্দ্র, বেশি যানজটের সড়ক ও ট্রাফিক সিগন্যাল, মসজিদ, বাস, ট্রেন, লঞ্চ টার্মিনালগুলোতে ভিক্ষুকদের আনাগোনা বেড়ে যায়। এ সময়ে অনেকেই মৌসুমি ভিক্ষুক বনে যান। নিজ নিজ এলাকায় কেউ দিনমজুর, কেউ রিকশাচালক, কেউ বাসায় করেন, আবার অনেকেই আত্মীয়তার সূত্র ধরে এসে এখানে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামছেন।
ময়মনসিংহ থেকে টুম্পা বেগম সোনারগাঁ হোটেলের মোড়ের ফুটপাতে বসে ভিক্ষা করছিলেন। তিনি বলেন, নিজ এলাকাতেও তিনি ভিক্ষা করেন। তবে প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি রোজার সময়ে ঢাকায় চলে আসেন। দুই ছেলেকে পড়াতে হয়। তাই কিছু বাড়তি আয়ের আশায় ঢাকামুখী হন। জানালেন, দিনে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় হয়।
ধানমন্ডির রাপা প্লাজার সামনে সিগন্যাল পড়লেই দল বেঁধে নেমে যায় ভিক্ষুকেরা। বড়দের সঙ্গে ছোট বাচ্চারাও নেমেছে। লায়লা নামের ১০ বছরের এক শিশু মায়ের সঙ্গে দুই বছর ধরে মুন্সিগঞ্জ থেকে আসে। সেখানে মা অন্যের বাসায় কাজ করে। কিন্তু রোজা এলেই ঢাকায় আসে। লায়লাদের আপাতত নিবাস ধানমন্ডি লেক।
ভিক্ষুকদের অনেকেই দল বেঁধে কোনো এক সরদারের অধীনে চুক্তিতে আসেন। প্রতিদিনের আয়ের নির্দিষ্ট একটি অংশ সরদারকে দিতে হয়। মাস শেষে সেখান থেকে সরদার নিজের ভাগের টাকা রেখে তাঁদের বাকি টাকা দেন। থাকার ব্যবস্থা সরদারই করেন। কিশোরগঞ্জের মো. হাকিমের বয়স ৬০ পার হয়েছে। বড় ছেলে এক সরদারের মাধ্যমে তাঁকে আরও কয়েকজনের সঙ্গে ঢাকায় ভিক্ষা করতে পাঠিয়েছেন। প্রথমবার এসেছেন। আরও তিনজনের সঙ্গে সারা দিন থাকেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে।
বেশি টাকা ও জাকাতের আশায় ভিক্ষুক বেড়ে যাওয়ায় নগরবাসীর অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করছেন। ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে কেনাকাটা করতে এসেছেন সিরাত সুলতানা। তিনি বলেন, ‘এঁরা এমনভাবে চারদিকে থেকে ধরে যে গাড়ি থেকেও অনেক সময় বের হওয়া যায় না। হাঁটতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে, নাছোড়বান্দা। কতজনকে দেওয়া যায়। আর এখন তো তাঁরা দুই-পাঁচ টাকা দিলে নিতে চায় না।’
ভিক্ষাবৃত্তি রোধ করতে সরকারের বিশেষ কর্মসূচি আছে। রাজধানীর সাতটি এলাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এরপরও নগরীতে, বিশেষ করে রোজার সময় ভিক্ষুক বেড়ে গেছে। এ নিয়ে সরকারের ভাবনা কী? উত্তরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভিক্ষাবৃত্তি রোধসংক্রান্ত প্রকল্পের অতিরিক্ত পরিচালক সৈয়দা ফেরদাউস আখতার বলেন, ‘রোজার সময় জাকাত-ফেতরার আশায় এসব মানুষ রাজধানীতে আসে। আমরা বিষয়টি একটু নমনীয়ভাবেই দেখি।’
তবে রমজানের পর জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ভিক্ষা বন্ধ করতে বড় অভিযান চলবে বলে জানান ফেরদাউস আখতার।