সদ্য সমাপ্ত আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মৌখিকভাবে যে আবেগঘন কথাবার্তা বলেছেন, লিখিত রিপোর্টে তার প্রতিফলন ছিল না। অতিরিক্ত সন-তারিখবিদ্ধ এই রিপোর্টে তিনি পৌনে চার বছরের বিভিন্ন সভার বিবরণেই অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ থেকে কাউন্সিলর ও প্রতিনিধিরা বঞ্চিত হয়েছেন। যদিও সভামঞ্চে সৈয়দ আশরাফের নাম ঘোষণাকালে তাঁরা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করেন।
সৈয়দ আশরাফ তাঁর রিপোর্টে দেশের সংকট বোঝাতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আজ এমন একটি সময়ে এই জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন এ দেশকে নিয়ে আবার নতুন করে শুরু হচ্ছে ষড়যন্ত্র। উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর মাধ্যমে জনমনে ভীতি সঞ্চার করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে এই অশুভ শক্তি।’ তার পরের বাক্যটি আরও ইঙ্গিতপূর্ণ, ‘চক্রান্ত চলছে একটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার, চক্রান্ত হচ্ছে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার।’ এরপর তিনি লিখেছেন, ‘এই কাউন্সিল শুধু নিয়মরক্ষার কাউন্সিল নয়—ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে, সেই জন্য এই কাউন্সিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
সৈয়দ আশরাফ দলীয় নেতা-কর্মীদের যেসব বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে ব্যক্তি ও দলের চেয়ে দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া, দ্বন্দ্ব-সংঘাত পরিহার করে গঠনতন্ত্র অনুসারে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা, কারও ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডে যাতে দল ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে সজাগ থাকা।
বিদায়ী সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে ‘অশুভ শক্তির চর, সন্ত্রাসী, মাদকসেবী, অসৎ ও বিতর্কিত ব্যক্তির’ যাতে দলে অনুপ্রবেশ না ঘটে, সে ব্যাপারে নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। যখন বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত বিএনপি এবং মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের ফুলের মালা নিয়ে ৬৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই দলটিতে যোগদানের খবর আসে, তখন সৈয়দ আশরাফ তাঁর রিপোর্টে এই সতর্কবার্তা দিলেন।
বিরোধী দলের অপপ্রচারের জবাব এবং সরকারের সাফল্য ও অর্জনকে জনগণের সামনে তুলে ধরারও তাগিদ দিয়েছেন দুবারের সাধারণ সম্পাদক। আগামী নির্বাচনে বিজয়ের জন্য জনগণকে সংগঠিত করার তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি তিনি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ১৪ দলে ও মহাজোটের ঐক্যকে সম্প্রসারিত করার ওপর জোর দিয়েছেন।
তবে তাঁর রিপোর্টে ২০১৪ সালের নির্বাচন, সেই নির্বাচনে ‘সাফল্য’ কিংবা সরকার গঠন সম্পর্কে তেমন কিছু নেই। নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর দলীয় সাধারণ সম্পাদক আহূত দুটি সংবাদ সম্মেলনের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলেও সেখানে তিনি তখনকার রাজনৈতিক সংকটের চিত্র সম্পর্কে কিছুই বলেননি। এমনকি উল্লেখ নেই নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত তারানকোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের বৈঠকের কথাও।
একইভাবে ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের বিষয়টিও তিনি এড়িয়ে গেছেন।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তাঁর রিপোর্টে দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা সম্পর্কে কোনো বক্তব্য না দিলেও তিনি যে বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত সাংগঠনিক সম্পাদকদের রিপোর্ট যুক্ত করেছেন, তাতে দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতাই উঠে এসেছে।
সাংগঠনিক সম্পাদকদের রিপোর্টে পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনের যে ফলাফলও সংযুক্ত করা হয়েছে, তাতে দেখা যায়, ২০ থেকে ৪০ শতাংশ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। ইউপি নির্বাচনে রাজশাহী বিভাগের ৫২৬টির মধ্যে ৩৬৫ জন দলের মনোনীত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। বাকিটা পেয়েছেন বিদ্রোহী বা অন্য দলের প্রার্থী। এই বিভাগের ৫৩টি পৌরসভার মধ্যে দলের মনোনীত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন ৩৬ জন। অন্যান্য বিভাগের পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনের চিত্রও কমবেশি অনুরূপ।
ঢাকা বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত আহমদ হোসেনের প্রতিবেদনে ২২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ১৫টি জেলার সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়। ১২৬টি উপজেলার মধ্যে প্রায় অধিকাংশ উপজেলার সম্মেলন শেষ হওয়ার কথা আছে। কিন্তু কতটির সম্মেলন হয়নি, সেই তথ্য জানা যায় না।
চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত সাংগঠনিক সম্পাদক বীর বাহাদুর উ শৈ সিংয়ের রিপোর্টে জানা যায়, কুমিল্লা মহানগর ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগের ১৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ১৪টিতে সম্মেলন হয়েছে। রাজশাহী বিভাগের সব কটি সাংগঠনিক জেলায় সম্মেলন হয়েছে বলে জানিয়েছেন আবু সাঈদ আল মাহমুদ। খুলনা বিভাগের প্রতিবেদন দাখিল করেন বি এম মোজাম্মেল হক। সেখানেও সব সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন হয়েছে বলে জানানো হয়। সিলেট বিভাগের মিজবাহউদ্দিন সিরাজের তথ্যমতে, সিলেট জেলা, মৌলভীবাজার জেলা ও সিলেট মহানগর সম্মেলন হয়নি। বরিশাল জেলার দায়িত্বে থাকা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এবং রংপুরের দায়িত্বে থাকা খালেদ মাহমুদ চৌধুরীর রিপোর্ট অনুযায়ী ওই দুই বিভাগের সব সাংগঠনিক জেলায় সম্মেলন হয়েছে।
সাধারণ সম্পাদকের যে রিপোর্ট সৈয়দ আশরাফ সম্মেলনে পেশ করেছেন তাতে দলের গত পৌনে চার বছরের কার্যক্রমের পূর্ণাঙ্গ ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন যেমন নেই, তেমনি সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা বা সমস্যার কথাও অনুক্ত রয়ে গেছে। ২০২১ রূপকল্প ঘোষণাকারী দলটির সাংগঠনিক রিপোর্ট অতীতের স্মৃতিতর্পণেই ভারাক্রান্ত।