কোনো কিছুকেই অসম্ভব মনে করছেন না মাহমুদউল্লাহ

SHARE

8ccd90422a0355bbc978f749599c0ec3-43টি-শার্ট গায়ে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই মাশরাফি বললেন, ‘ভালো ঠান্ডা তো!’
ধর্মশালায় তখন বিকেল সাড়ে চারটার মতো বাজে। একটু আগেও এত ঠান্ডা ছিল না। একপশলা শিলাবৃষ্টি ধুম করে তাপমাত্রা নামিয়ে এনেছে। কাগজে-কলমে তা ১৭-১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তবে গায়ে এসে লাগছে যেন আরও ৩-৪ ডিগ্রি কম হয়ে।
নিচে চাকা লাগানো হাতের ছোট্ট স্যুটকেসটা একটা বাধা পেরোতে একটু তুলে ধরতে হলো। মাশরাফি অস্ফুটে বললেন, ‘মনটা খুব খারাপ তো! তাই ব্যাগটা এত ভারী লাগছে।’
মন খারাপের কারণটা বোধ হয় খুলে না বললেও চলছে। আগের রাতের এশিয়া কাপ ফাইনাল তখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ অধিনায়ককে। ‘টসটা হেরেই ম্যাচটা হেরে গেলাম। ১৫ ওভারের ম্যাচে দেড় শ করেও জেতা কঠিন। হাতে ১০ উইকেট নিয়ে পরে ব্যাটিং করলে ওটাও করে ফেলা যায়’—মাশরাফির মুখে বিষণ্নতার আঁকিবুঁকি।
তবে বিষণ্নতাকে যে একটু প্রশ্রয় দেবেন, সেই সময়ও হাতে নেই। এশিয়া কাপ শেষ হতে না হতেই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। যেটির মূল পর্বে খেলতে আবার উত্তীর্ণ হতে হবে বাছাইপর্বের পরীক্ষায়। আইসিসি যতই ‘প্রথম পর্ব’ নাম দিক, আসলে তো বাছাইপর্বই। যে বাছাইপর্ব শুরু হচ্ছে আজ থেকে। যেটিতে ‘এ’ গ্রুপে বাংলাদেশের সঙ্গী হল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও ওমান। যেখান থেকে শুধু একটি দলই উঠবে সুপার টেনে। আগে থেকেই ফেবারিট ছিল বাংলাদেশ, এশিয়া কাপের পর তো আরও।
ফাইনাল শেষে গভীর রাতে মাঠ থেকে ফিরে সাতসকালেই দিল্লির বিমানে উঠতে হয়েছে। দিল্লি থেকে স্পাইসজেটের ভাড়া করা বিমানে ধর্মশালায়। মাঝখানে ঘণ্টা আড়াইয়ের যাত্রাবিরতি। মাশরাফিদের চোখেমুখে তাই ক্লান্তির ছাপ। সেটি নিয়েই একে একে অপেক্ষমাণ বাসে উঠলেন সবাই। সবার শেষে উঠলেন মাহমুদউল্লাহ।
মাশরাফিরা আসার আগেই ধর্মশালায় পৌঁছে গেছেন বাংলাদেশের সাংবাদিকদের একটি বহর। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এটাকে ব্যতিক্রমই বলতে হবে যে, বিদেশে দলকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাচ্ছেন সাংবাদিকেরা! বিমানবন্দরে তাঁদের জটলাটা অবশ্যই শুধু স্বাগত জানাতে নয়। লেখার রসদ জোগাড় করাটাও একটা উদ্দেশ্য। ফাইনাল শেষে মাশরাফি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সকালে দেশ ছাড়ার আগে বিমানবন্দরেও আবার কথা বলতে হয়েছে। নতুন আর কী শোনা যাবে তাঁর কাছ থেকে! সাংবাদিককুল তাই দ্রুতই মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে একমত হয়ে গেল।
ফাইনালে লড়াই করার মতো একটা স্কোর এনে দিয়েছিল তাঁর ছোট্ট ঝোড়ো ইনিংসটিই। সেটি যথেষ্ট প্রমাণিত না হওয়ায় মাহমুদউল্লাহর মন অবশ্যই খারাপ, তবে তিনি সান্ত্বনা খুঁজতে চাইছেন বৃহত্তর ছবিটার দিকে তাকিয়ে, ‘একটু হতাশ তো বটেই, ভালো একটা সুযোগ ছিল। তবে এই টুর্নামেন্টে আমরা যেভাবে খেলেছি, আমাদের জন্য তা বড় একটা ধাপ পেরোনো।’
মাত্রই পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার মতো দলকে হারিয়ে যে বাংলাদেশ এশিয়া কাপ ফাইনাল খেলে এসেছে, তাদেরই নাকি খেলতে হচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে! একটু অদ্ভুত তো লাগছেই। টি-টোয়েন্টির র্যা ঙ্কিংয়ে সেরা আটের বাইরে থাকায় এটি অবশ্য অনেক আগেই ঠিক হয়ে আছে। অনুযোগ করার তাই কোনো সুযোগ নেই। তা করছেনও না মাহমুদউল্লাহ। বরং গত কিছুদিন তাঁর ব্যাটিংয়ে যে ইতিবাচকতার বার্তা, এটিকেও দেখছেন সেই চোখেই, ‘এখানে খেলাটা আমাদের জন্য ভালোই হবে। মূল পর্বের জন্য ভালো একটা প্রস্তুতি হয়ে যাবে।’
এশিয়া কাপ না থাকলে আরও আগেই ধর্মশালায় পা পড়ত বাংলাদেশ দলের। ভিন্ন কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য দুটি প্রস্তুতি ম্যাচও নির্ধারিত ছিল। এখন প্রস্তুতি ম্যাচ-ট্যাচ দূরে থাক, এক দিন অনুশীলন করেই নেমে যেতে হচ্ছে হল্যান্ডের বিপক্ষে। খোলা মাঠে সেই অনুশীলন করার সুযোগ মিলবে কি না, এ নিয়েও সংশয় আছে। কাল বিকেল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি, সন্ধ্যার পর থেকে বিরতিহীন ঝরে চলেছে। মাঠ-উইকেটের সঙ্গে কোনো পরিচয় ছাড়া শুধু ইনডোরে নিজেদের ঝালিয়ে নিয়েই কাল বাংলাদেশকে নেমে পড়তে হলো ম্যাচ খেলতে, এমন আশঙ্কা তাই আছেই।
তবে এশিয়া কাপ থেকে এমনই আত্মবিশ্বাসের জ্বালানি জোগাড় করে নেওয়া গেছে যে, সেটিকেও খুব বড় কোনো সমস্যা মনে হচ্ছে না মাহমুদউল্লাহর কাছে, ‘ম্যাচ খেলার চেয়ে ভালো প্র্যাকটিস আর কী হয়! আমরা কঠিন সব ম্যাচ খেলে এসেছি। তা ছাড়া শুনেছি, এখানে এই সময় উইকেট খুব ভালো হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে খেলা হলে ভিন্ন কথা ছিল। তখন নাকি অনেক ঠান্ডা থাকে। আর প্রথম খেলাটাও বিকেলে, আমরা ঠিকই মানিয়ে নিতে পারব।’
‘মানিয়ে নেওয়া’র আত্মবিশ্বাস মাহমুদউল্লাহর মুখে খুব ভালো মানায়। টি-টোয়েন্টিতে তাঁর কার্যকারিতা নিয়ে বড় একটা প্রশ্ন ছিল, সেটির সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। ৬-৭ নম্বরে খেলার জন্য বিশেষায়িত অনুশীলনের চেয়েও মানসিকতার পরিবর্তনকে বেশি কৃতিত্ব দিচ্ছেন এ জন্য। অস্ট্রেলিয়ায় ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে টানা দুই সেঞ্চুরি করে রাতারাতি নায়ক হয়ে গিয়েছিলেন। এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও শুরু করছেন ফর্মের তুঙ্গে থেকে। এবারও কি ‘হিরো’ হতে পারবেন?
এক সাংবাদিকের প্রশ্নটা শেষ করতে না দিয়েই মাহমুদউল্লাহ জানিয়ে দিলেন নিজের চিরন্তন দর্শনটা, ‘আমি হিরোইজমে বিশ্বাস করি না। দলে অবদান রাখতে পারাটাই আমার কাছে আসল কথা।’
টি-টোয়েন্টিতে এখনো বাংলাদেশের কোনো সেঞ্চুরি নেই। ৬-৭ নম্বরে নেমে মাহমুদউল্লাহ তা করে ফেলবেন, এই আশা করাটাও বাড়াবাড়ি। কিন্তু কী আশ্চর্য, কাজটাকে কঠিন বললেও সম্ভাবনাটাকে একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
‘আত্মবিশ্বাস’ এমনই এক টনিক! যা কোনো কিছুকেই অসম্ভব মনে না করার সাহস জোগায়!