চিরশান্তির দেশে চলে গেলেন বাবা

SHARE

11984270_10207324692738617_121161935_oপ্রতিটা মৃত্যুই কষ্টের। আর সেই মৃত্যু যদি হয় আপনজনের, তাও আবার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি নিজের বাবার। তাহলে এই মৃত্যুর ভার বহন করাটা যে কতো ব্যথার তা শুধু সেই বলতে পারবে, যে তার বাবাকে হারিয়েছে। বাস্তবতা সবারই মেনে নিতে হবে, আমার ও মেনে নিতে হবে। তবে প্রাপ্তির আনন্দ আর না পাওয়ার কিছু ব্যথা থেকে যায়। বাবার মৃত্যুর শেষ মূহুর্তে কিছু ঘটনা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। শুক্রবার (২৮ আগস্ট ২০১৫) সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বাজার করতে বের হয়েছি। কিছু সময় পরে বাসা থেকে ফোন আসলো বাবা অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে, আমি দ্রুত বাসায় ফিরে আসলাম। বাবার রুমে যেতেই বাবা বললো তার বুকে খুব ব্যথা। হার্টে সমস্যা থাকার কারনে মাঝে মাঝেই বুকে ব্যথা হয়। ব্যথা উঠলে নিডোকার্ড স্প্রে দিলে ব্যথা চলে যায়। স্প্রে দিলাম কিন্তু ব্যথা কমছে না। বাসার কাছে ফরাজী হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স ফোন করলাম, এ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার বাচ্চু বললো পাঁচ মিনটি পরে জানাচ্ছি যেতে পারবো কিনা। দশ মিনিট পার হলো, এবার আমি ফোন করলাম কিন্তু মোবাইল বন্ধ। অনেক্ষন ট্রাই করে না পেেেয় অন্য এ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করলাম। এ্যাম্বুলেন্সে করে মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশন এ নিয়ে গেলাম। ইমার্জেন্সীতে ডাক্তার দেখে বললেন উনার হার্ট এবং কিডণী দুটোতেই সমস্যা। উনাকে কিডণী ফাউন্ডেশনে ভর্তি করেন। বাবাকে বললাম কিডণী ফাউন্ডেশনে ভর্তি করতে হবে। বাবা বললেন তুমি আমাকে এখানেই ভর্তি করো। কিডণী ফাউন্ডেশনের ডাক্তার নার্স এদের ব্যবহার ভালো না। কিছুদিন আগে বাবা কিডণী ফাউন্ডেশনে ভর্তি ছিলেন। ইমার্জেন্সীর ডাক্তারকে বললাম আমার বাবা এখানে ভর্তি হতে চাচ্ছে। ডাক্তার বললেন এখানে সিট ফাকা নাই। আমি অনেক অনুরোধ করার পর বললেন ভর্তি করতে পারি তবে একজন কিডণীর ডাক্তার এখানে আনার ব্যবস্থা করবেন। আমি ডাক্তারের কথায় রাজী হলাম। বাবাকে দুপুর দুইটার সময় ভর্তি করা হলো হার্ট ফাউন্ডেশনে, চারটা থেকে তিনি অনেকটা সুস্থ্য। কথা বলছেন, খাবার খাচ্ছেন, (৩ সেপ্টেম্বর) হজ্জ্বে যাওয়ার তারিখ ঠিক হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। রাত দশটার দিকে বাবাকে হাসপাতালে রেখে বাসায় ফিরলাম। হাসপাতালে বাবার কাছে আম্মা থাকলেন। সকালে আম্মা ফোন করে বললেন তোমার বাবাকে রাত ১২টায় সিসিইউতে নিয়ে গেছেন। আমি আর আমার বোন (২৯ আগস্ট) সকাল ছয়টায় হাসপতালে পৌছালাম, আম্মা বসে বসে কাঁদছেন। আমি সিসিইউতে গিয়ে দেখি আমার বাবা ঘুমাচ্ছেন। খবর শুনে আমাদের আত্নীয়-স্বজনরা অনেকেই আসলেন। দুপুর ২ টার পর বাবা কথা বলছেন, তিনি সবাইকে চিনতে পারছেন। আমরাও আশার আলো দেখতে শুরু করলাম। বাবার উন্নতি দেখে ডাক্তাররা বললেন আপনি একজন কিডণীর ডাক্তার নিয়ে আসেন। কিডণী ফাউন্ডেশনে গেলাম। তথ্য কেন্দ্র থেকে বললেন ডাঃ সাকিব-উজ-জামান স্যার যাবেন। আমি আর সুজন ভাই দুই ঘন্টা অপেক্ষা করে উনার সাথে দেখা করলাম। ডাঃ সাকিব-উজ-জামানকে বললাম স্যার প্লিজ আমাকে সাহায্য করেন। উনি আমার সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করলেন, বললেন আমাকে কি আপনার সস্তা ডাক্তার মনে হয়, আপনার বাবা মরে গেলে আমার কি, আমার চা খাওয়ার ও সময় নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ধৈর্য্য ধারণ করে ফিরে আসলাম। শেষ ভরসা ফরাজী হাসপাতালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডাঃ মোক্তার হোসেনকে ফোন করে ঘটনা বললাম, উনি বললেন এখন যেতে পারবেন না, তারপরও ডাক্তারের সাথে কথা বলে এখনই জানাবেন। উনার ফোনের অপেক্ষা করছি, পরে নিজেই আবার উনাকে কল করলাম কিন্তু উনি বললেন একটা মিটিংয়ে ছিলেন এখনই ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানাচ্ছি। ফরাজী হাসপাতালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডাঃ মোক্তার হোসেনকে অনেক অনুরোধ করলাম। তাছাড়া আমার সাথে তার অনেক সখ্যতা, আমার বাবা মানে তারও বাবার মতো। কিন্তু উনি আর ফোন করলেন ও না, ধরলেন ও না। ফরাজী হাসপাতালের চেয়ারম্যান আমার খুবই কাছের বন্ধু মানুষ, তাকে অনেকবার ফোন করলাম কথাটা জানানোর জন্য, তিনি হয়তো ব্যস্ত ছিলেন তাই রিসিপ করতে পারেন নাই। অন্য সময় ব্যস্ত থাকলে কল ব্যাক করেন। কিন্তু (৫ সেপ্টেম্বর)এখন পর্যন্ত ফোন করে সমবেদনাটুকো জানান নাই। যাই হোক এ্যাম্বুলেন্সের ঘটনাটা ফেইসবুকে তাকে আমি ঐদিনই(২৮ আগস্ট) জানালাম, তিনি (২৯ আগস্ট) লিখলেন এখন পাঠাবো কি না? ডাক্তারদের জানালাম আমি কিডণীর ডাক্তার ম্যানেজ করতে পারি নাই। আমাকে বললেন খুবই দরকার ছিলো, যেহেতু পারেন নাই কাল সকালে আমরা ম্যানেজ করে নিবো। রাত ১০:৩০মিনিট পর্যন্ত বাবার কাছে ছিলাম, স্যুপ খেলো, কলা খেলো, পানি খেলো, অনেক বিষয় নিয়ে কথা হলো। বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, বাবা ঘুমাচ্ছে। আমি বাসায় আসলাম রাত ১১:৫০ মিনিট, গোসল সেরে খেয়ে বিছানায় আসলাম। রাত ১২:৫০ মিনিটে ডাক্তার ফোন করলেন আপনার বাবার অবস্থা খারাপ। আমি রাত ১:২৮ মিনিটে হাসপাতালে পৌছালাম, বাবা তখনও ঘুমাচ্ছেন, ডাক্তার ১:৩০মিনিটে বললেন একজন কিডণীর ডাক্তার আনতে পারলে হয়তো এমনটি নাও হতে পারতো, নার্সকে বললেন চাঁদর দিয়ে ঢেকে দাও। আমি যাওয়ার আগে বাবাকে যে ভাবে রেখে গিয়েছিলাম বাবা সেইভাবেই ঘুমাচ্ছেন। আমি বাবার কপালে মুখে হাত দিলাম, বাবাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে হার্টবিট শোনার চেস্টা করছি। নার্সরা আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন। কখনো বুঝিনি বাবা এইভাবে আমাকে একা করে চিরশান্তির দেশে চলে যাবেন।