হত্যা নাশকতা মামলার আসামিরা আ’লীগে

SHARE

ctgচট্টগ্রামে হত্যা, নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলার আসামিরা গা বাঁচাতে দলে দলে যোগ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগে! তিন পার্বত্য জেলায় সম্প্রতি বিএনপি ও জামায়াত ছেড়ে ‘মুজিব সেনা’ হয়েছেন ১০ সহস্রাধিক নেতাকর্মী। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তাদের অনেকেই নাশকতা মামলার আসামি। কেউ কেউ আবার দলবদল করেছেন পদের লোভে। চট্টগ্রাম নগরীতেও চলছে ডিগবাজির রাজনীতি। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আদর্শ ত্যাগ করে সম্প্রতি মহানগর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন ৪৫ নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে আছেন মামলার আসামি। সর্বশেষ রোববার বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে গেছেন রাউজানের বিএনপি নেতা সালামত আলী। তিনি যুবলীগ নেতা মোবারক হত্যা মামলার আসামি। হঠাৎ করে বিভিন্ন মামলার আসামি ও সুবিধাভোগী নেতারা এভাবে দলবদল করায় বিব্রত পুলিশ প্রশাসন। আওয়ামী লীগেও এ নিয়ে তৈরি হচ্ছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম বলেন, ‘দলবদল করা ব্যক্তিরা সাধারণত সুবিধাভোগী হয়। এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’ বিএনপির নীতি এবং আদর্শে হতাশ হয়ে অনেকে
দলবদল করছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে মহানগর পুলিশ কমিশনার আবদুল জলিল মণ্ডল বলেন, ‘সন্ত্রাসী ও নাশকতাকারীদের কোনো দল নেই। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় গিয়ে তারা ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করবে।’
পাহাড়ের তিন জেলায় ১০ সহস্রাধিক নেতাকর্মীর দলবদল :রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের তিন জেলাতে প্রতি সপ্তাহেই কেউ না কেউ দলবদল করে যোগ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগে। গত ২৪ মে বান্দরবানে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে আসেন ৩০ নেতাকর্মী। একই সময় লামা উপজেলা আওয়ামী লীগে যোগদান করেন বিএনপির একদল নেতাকর্মী। খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে একদিনে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন বিএনপির দেড় সহস্রাধিক নেতাকর্মী। একই জেলার দীঘিনালায় এমন দলবদল করা নেতাকর্মী আছেন সাড়ে পাঁচ হাজার! রাঙামাটিতেও ডিগবাজি খাওয়া নেতাকর্মীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

ডিগবাজ নেতাদের তালিকায় নাশকতা মামলার আসামি :কামাল হোসেন। কলেজ ছাত্রদল নেতা। থাকেন মানিকছড়ির জিয়ানগরে। নাশকতা মামলার আসামি হওয়ায় সম্প্রতি দলবদল করে ‘মুজিব সেনা’ হয়েছেন তিনি। একই জেলার মাস্টারপাড়া এলাকার ছাত্রদল নেতা জাহেদ মিয়ার নামেও আছে নাশকতার মামলা। তিনিও এখন আওয়ামী লীগে। বিষয়টি স্বীকার করে উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘দলবদল করা নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছু মামলার আসামি থাকতে পারে।’ একই প্রসঙ্গে সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা বাদশা মিয়া বলেন, ‘দলবদল করে আওয়ামী লীগে আসা লেমুয়া ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি সালাহউদ্দিনের নামে নাশকতা মামলা রয়েছে বলে জানি।’ সমকালের মানিকছড়ি প্রতিনিধি মনির হোসেন মনির জানান, গত ২৯ মে খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলায় একসঙ্গে দেড় সহস্রাধিক বিএনপি নেতাকর্মী যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগে। তাদের মধ্যে রয়েছেন শ্রমিক দলের সভাপতি আবদুর রব, বিএনপি নেতা হানিফ মেম্বার, ফজর আলী ওরফে হজু মেম্বার, মো. হাছান, নবী সওদাগর, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নান, তিনটহরী ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি আহম্মদ ছফা, সহসভাপতি আবুল কাশেম, ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মাহবুবুল আলম, বাকনাতলী ইউনিয়ন বিএনপির প্রচার সম্পাদক মো. ইউনুস, ৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন, যুবদলের সভাপতি অহিদ মিয়া, মহিলা মেম্বার রজ্জবের নেছা, মরিয়ম বিবি প্রমুখ।

দীঘিনালায় প্রায় সবাই আওয়ামী লীগে :খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় এখন প্রায় সবাই আওয়ামী লীগে। বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, শ্রমিক দল, মহিলা দল, তাঁতী দলের শীর্ষ নেতাসহ প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কর্মী যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগে। উপজেলা প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম রাজু জানান, গত বছরের ১২ মে থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার নেতাকর্মী ১৫ দফায় দলবদল করেন। দলবদলের পাইপলাইনে আছেন আরও শতাধিক নেতাকর্মী। এ প্রসঙ্গে দলবদল করা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মো. সেলিম বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচন ও শান্তিচুক্তি ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানে বিরক্ত হয়ে আমার মতো বিএনপির অনেক নেতাকর্মী যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগে।’ অন্যদিকে উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোছলেম উদ্দিন বলছেন, ‘যারা গেছে তারা কেউ দলের সক্রিয় নেতাকর্মী নন। সুবিধাভোগীরাই যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলে।’

পদের লোভেও অনেকে ছাড়ছে দল :বান্দরবান জেলা প্রতিনিধি উজ্জ্বল তংচঙ্গ্যা জানান, দলীয় কোন্দলে কোণঠাসা থাকা ব্যক্তিরাও নতুন সুযোগ-সুবিধার আশায় বেছে নিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তাদেরই একজন সম্প্রতি দলবদল করা বান্দরবান সদর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাছা খেয়াং। বিএনপির অভিযোগ, আওয়ামী লীগ তাকে জেলা পরিষদের সদস্য হওয়ার টোপ দিলে ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগে যোগ দেন তিনি। একইভাবে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে এসেছেন আগে একবার দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়া জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু মুছা ফারুকী। দলবদল করা অন্যদের মধ্যে আছেন, লামা উপজেলার পাইতং ইউনিয়ন বিএনপির সিনিয়র সদস্য মন্টু সিকদার, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন প্রমুখ।

মহানগরেও দলবদলের হিড়িক :চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের হাতে ফুল দিয়ে গত ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগে যোগদান করেন পশ্চিম বাকলিয়া বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল ও জাতীয় পার্টির ৪৫ নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে আছেন_ নগর জাতীয়তাবাদী দলের সাবেক সদস্য মুহাম্মদ শফি, জাতীয় পার্টি সমর্থিত যুব সংহতির চকবাজার থানার আহ্বায়ক মুহাম্মদ আবদুর রহমান রাশেদ, ওয়ার্ড যুবদলের মুহাম্মদ রবিউল হাসান, ইশতিয়াক আহমদ, রাজেশ্বর চৌধুরী প্রমুখ। মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি গাজী সিরাজ বলেন, ‘দলবদল করা এসব ব্যক্তি ছাত্রদল কিংবা যুবদলের কেউ নন। মামলা থেকে বাঁচতে ও হালুয়া-রুটির লোভে তারা ভিড়েছেন ক্ষমতাসীন দলে।’ জানা গেছে, তাদের মধ্যেও দু’জন নাশকতা মামলার আসামি। চুরি ও ছিনতাই মামলার আসামিও আছেন দু’জন। যুবলীগ নেতা মোবারক হত্যা মামলার আসামি বিএনপি নেতা ছালামত আলীও রোববার দলবদল করে গেছেন আওয়ামী লীগে।
রাউজান উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব ছালামত আলীর নাটকীয় ঘটনা নিয়ে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় চলছে। রাউজান প্রতিনিধি জানান, গত রোববার বিকেলে নগরীর রীমা কমিউনিটি সেন্টারে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির ইফতার মাহফিলে যোগদান করতে গেলে রাউজানের নোয়াপাড়া ফাঁড়ি পুলিশ ছালামত আলীকে গ্রেফতার করে। প্রথমে পুলিশ তাকে গ্রেফতারের বিষয়টি অস্বীকার করে। একদিনের মাথায় হঠাৎ তিনি নিজ দল বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করায় বিষয়টি নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। জানতে চাইলে রাউজান থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ সমকালকে বলেন, ‘পুলিশের ওপর হামলা-মামলায় ছালামত আলীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এরপর তাকে আদালতে সোপর্দ করার আগে মামলার ডকেট ঘেঁটে আমরা জানতে পারি এ মামলায় যে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে তাতে তার নাম নেই। ফলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’

সোমবার সন্ধ্যার দিকে রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দলের সভাপতি শফিকুল ইসলাম চৌধুরীর হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন ছালামত আলী।