হাজার হাজার লিটার ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের খাল-বিল ও নদীতে। শুক্রবার বোয়ালখালীতে সেতু ভেঙে রেলের ওয়াগন খালে পড়ে যাওয়ার পর তেল দ্রুত অপসারণ না করায় জোয়ার-ভাটায় তেল ছড়িয়ে পড়ছে কর্ণফুলী নদী হয়ে সাগরেও। শুক্রবার দুপুরে দুর্ঘটনায় খালের মাধ্যমে তেল ছড়িয়ে পড়লেও এ তেল অপসারণে কাজই শুরু করতে পারেনি রেলওয়ে ও পরিবেশ অধিদপ্তর। এতে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।
কর্ণফুলী ও হালদা নদী নিয়ে গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘দুর্ঘটনায় প্রায় এক লাখ লিটার তেল খাল-বিল ও নদীতে ছড়িয়ে পড়েছে। এ তেল গিয়ে পড়ছে সাগরেও। ফলে খাল, নদী ও সাগরের জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেবে। পানির উপরে তেল ভেসে থাকার কারণে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পাওয়ায় মাছসহ অন্যান্য প্রাণী মারা যেতে পারে। ফার্নেস তেল সাগরের উপকূলে গিয়ে পড়লে রেণু মাছগুলোরও একই দশা হতে পারে। আবার খাল হয়ে তেল ফসলি জমিতে গিয়ে পড়ায় ফসলি জমিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং মাটির দূষণ ঘটবে।’
বোয়ালখালী ও পটিয়া উপজেলা সীমান্তে রেলের একটি ব্রিজ ভেঙে তিনটি ওয়াগন থেকে প্রায় ৭৫ হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল বোয়ালখালী হারগাজি খালে ছড়িয়ে পড়ে। এ খালটির সঙ্গে কর্ণফুলী নদী ও শ’খানেক ছোট-বড় শাখা খাল সংযুক্ত।
গতকাল শনিবার পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের ব্যবহার করে দেশীয় পদ্ধতিতে খাল থেকে তেল তুলে নিতে পরামর্শ দেন রেলওয়ে কর্মকর্তাদের। এ পদ্ধতিতে খালের যেসব পয়েন্টে বেশি পরিমাণে তেল জমে রয়েছে, সেসব পয়েন্টে হাড়ি-পাতিল দিয়ে তেল তুলে নেওয়া হবে। পাশাপাশি বাঁশের চাটাই ও খড়ের বাঁধ দিয়ে ভেসে থাকা তেল অপসারণ করা হবে।
সুন্দরবনে শ্যাওলা নদীতে জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়লে এলাকার লোকজন দল বেঁধে হাড়ি-পাতিল নিয়ে সেই তেল তুলে নিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেও সে ধরনের আগ্রহ দেখাচ্ছেন না এলাকাবাসী। ফলে মজুরি দিয়ে তেল অপসারণে লোকজনকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। তবে গতকাল বিকেল ৫টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তেল অপসারণের কাজই শুরু করতে পারেননি তারা!
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মকবুল হোসেন বলেন, ‘দুর্ঘটনায় রেলের ওয়াগন থেকে খালে ছড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েল কর্ণফুলীসহ বিভিন্ন খালের পানিতে মিশে গেছে। আমরা স্থানীয়দের দিয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে তেল তুলে নিতে রেলওয়েকে পরামর্শ দিয়েছি। এ পদ্ধতিতে স্থানীয়দের মাধ্যমে খালগুলোতে খড় ও বাঁশের চাটাই দিয়ে তেল তুলে নেওয়া হয়। তবে জোয়ার-ভাটার কারণে অনেক তেল নদী হয়ে সাগরে চলে যাচ্ছে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘খালে সামান্য তেল পড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর আমাদের যেভাবে পরামর্শ দিচ্ছে, আমরা সেভাবে কাজ করছি। লোক লাগিয়ে স্থানীয়ভাবে তেলগুলো তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছি।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘সরকার মৎস্য উৎপাদন বাড়াতে দুই মাস সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রেখেছে। কিন্তু যেভাবে নদী-সাগরে তেল ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে মাছের প্রজননের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘সরকার যেহেতু সব বিদ্যুৎকেন্দ্রে ফার্নেস ওয়েল ব্যবহার করছে, তাই এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধের জন্য ফায়ার সার্ভিসের মতো ইউনিট গড়ে তোলা দরকার। যারা উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পানি থেকে তেল ছেঁকে তুলে নিতে পারবে।’
বোয়ালখালী খালে নিয়মিত মাছ আহরণ করেন স্থানীয় জেলেরা। কিন্তু খালের পানি তেলে সয়লাব হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। তেলের কারণে পানিতে নামতে পারছেন না। মাছের আশায় খালে নেমে তেলে জবুথবু স্থানীয় জেলে মৃদুল দে বলেন, ‘যেভাবে তেল ছড়িয়ে পড়েছে তাতে খালের সব মাছ মরে যাবে। তা ছাড়া পানি থেকেও বিশ্রি দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। তাই পানিতেই নামা যাচ্চ্েছ না। মাছ শিকার করতে না পারলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।’
চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইনের বোয়ালখালী-পটিয়ার সীমান্ত খালে উপজেলার বেঙ্গুরা স্টেশনের অদূরে সায়েরারপুল এলাকায় একটি ব্রিজ ভেঙে খালে পড়ে যায় দুটি ফার্নেস অয়েলভর্তি ওয়াগন। এ দুটি ওয়াগনের পাশাপাশি লাইনচ্যুত হওয়া আরও একটি ওয়াগন থেকে পানিতে ছড়িয়ে পড়ে ফার্নেস অয়েল। প্রতিটি ওয়াগনে ২৪ হাজার ৮৯৫ লিটার করে ফার্নেস ছিল। নগরীর পাহাড়তলী থেকে দোহাজারীর পিকিং পাওয়ার প্লান্টের জন্য আটটি ওয়াগনে করে ফার্নেস অয়েল নিয়ে যাচ্ছিল রেলওয়ে।
এর আগে ২০১৩ সালে ৩০ জুলাই একই রুটের কালুরঘাট ব্রিজ সংলগ্ন বোয়ালখালীর কধুরখীর এলাকায় লাইনচ্যুত হয় তিনটি ফার্নেস অয়েলভর্তি ওয়াগন। এতে খাল ও কর্ণফুলী নদীতে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ৫৮ হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল।