আজকের দিনটাকে বোঝার জন্য ক্যালেন্ডারের পিছনের পৃষ্ঠাগুলি জানা প্রয়োজন। সেই লাল-কালো দিনগুলি তো নিছক সংখ্যা নয়। পৃথিবীর মানুষ ক্রমশ গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে। আব্রাহাম লিঙ্কন (১৮০৯-১৮৬৫) আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন এক জটিল সঙ্কটজনক সময়ে (১৮৬০)। সমগ্র দেশ তখন দাসপ্রথা অবলুপ্তির প্রশ্নে বিভক্ত। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের প্রদেশ যেগুলি ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক, তারা দাসত্বকে বজায় রাখতে চেয়েছিল।
তারা কী মনে করত? তারা মনে করত তাদের অর্থনীতির জন্য এই প্রথা চালু থাকা প্রয়োজন। উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলিও দাসপ্রথা বহাল রাখার জন্য পৃথক এক কনফেডারেশন গঠন করেছিল। তাতে প্রমাণ হয়, উত্তরের প্রদেশগুলি সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িত। অবশেষে আব্রাহাম লিঙ্কন মনে করলেন যে সমগ্র দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে রাখার জন্য যুদ্ধ এবং দাসত্বের অবলুপ্তি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এর ফলে আমেরিকা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। প্রায় চার বছর এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়। অবশেষে দাসপ্রথা পরাস্ত হয়।
এখন নরেন্দ্র মোদি আবার এ দেশে রাজত্ব করবেন কি করবেন না তার জন্য পাঁচ বছরের শাসন সম্পূর্ণ হলে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে মানুষ তার মতামতের মাধ্যমে ঠিক করবেন। এখন ১৮৬০ নয়, ২০১৫।
রাষ্ট্রপতি পদে ১৮৬৪ সালে লিঙ্কনের পুনর্নির্বাচন হয়। সেই উপলক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সঙ্ঘ তাকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি বার্তা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সেটির খসড়া করেছিলেন কার্ল মার্কস। মার্কসের রচনাবলিতে এটি পাওয়া যায় না। তবে প্রথম আন্তর্জাতিক কার্যবিবরণীতে (মিনিটস) সেটি সংরক্ষিত হয়েছে।
শৈলেশ বিশ্বাস এই কার্যবিবরণীর গ্রন্থনা ও তর্জমা করেন। ‘উৎস মানুষ’-এর ৪৮তম বর্ষ তিন নম্বর সংখ্যায় সেটি প্রকাশিত হয়। ‘দ্য বী হাইভ’ সংবাদপত্রে ১৮৬৫ সালের ৭ নভেম্বর এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। লন্ডনস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত চার্লস ফ্রান্সিস আডামসকে ১৮৬৫-র ২৮ জানুয়ারি এটি প্রদান করা হয়।
এই বার্তায় বলা হয়, দাসশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যদি আপনার প্রথম নির্বাচন ভবিষ্যতের সতর্কবার্তা হয়ে থাকে তা হলে পুনর্নির্বাচনের বিজোয়ল্লাসের রণধ্বনি হচ্ছে দাসত্বের মৃত্যু।
রাষ্ট্রদূত অ্যাডামস জবাব দেন এই প্রস্তাবের। তাতে তিনি লেখেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের একটা স্বচ্ছ চেতনা রয়েছে যে তার নীতি এখনও যেমন, ভবিষ্যতেও তেমন কখনও প্রতিক্রিয়াশীল হবে না। কিন্তু একই সময়ে শুরুতেই তারা স্থির করেছে যে সর্বত্র তারা স্বমত প্রচারে এবং বেআইনি হস্তক্ষেপে বিরত থাকবে।…এখানেই শেষ নয়। এর পর তিনি আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হিসাবে যা লেখেন তা দেখে চমস্কির বা জিজেকের মতো চিন্তবিদেরা কী বলবেন সেটাই ভাবাবে আমাদের। চার্লস অ্যাডামস লেখেন, জাতিসমূহ কেবলমাত্র নিজের জন্য বেঁচে থাকে না, কল্যাণমুখী আদানপ্রদানের ও বিনিময়ের মধ্য দিয়ে মানবজাতির কল্যাণ ও সুখের চেষ্টা করে। এ ভাবে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে দাসত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে সমর্থন করছে এবং ইউরোপের শ্রমজীবী মানুষের বিভিন্ন সংগ্রামর ইতিহাস থেকে নতুন প্রেরণা পেয়েছে। তাদের উচ্ছ্বসিত সমর্থন এবং আন্তরিক সহানুভূতি তাদের জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনসূচক। আর আজ আমেরিকা কী করছে সে আলোচনায় আমরা নাই বা গেলাম!
কিন্তু কার্ল মার্কসের মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বলশেভিক বিপ্লব করলেন লেনিন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের কী পরিণতি দেখলাম আমরা। দুনিয়া থমকে দেওয়া সেই তিন দিনটি মনে করুন, শুধু দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন মনে রাখলে হবে?
গোরবাচেভ তিন-চার দিনের জন্য ছুটি উপভোগ করছিলেন তার স্ত্রী, জামাতা-কন্যা ও নাতনিদের নিয়ে। এ সময় সন্ধ্যার দিকে একটি সোভিয়েত টোপোলেভ ১৩৪ প্লেন ক্রিমিয়াতে নামল। এলেন কেজিবি-র জেনারেল ইউরি প্লেখানভ। গোরবাচেভ তাকে আসতে বলেননি, কিন্তু কেজিবি-র নির্দেশে তিনি এসেছেন। এবং তাকে ইস্তফা দেওয়ার নির্দেশ নিয়ে। গোরবাচেভ দেখলেন, তিনি যে প্রাসাদে আছেন তার সমস্ত টেলিফোনের লাইন কাটা। স্বাস্থ্যের কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগ করলেন এবং তারপর ইয়ানায়েভ ক্ষমতাসীন হলেন। প্রাভদা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তারপর গন্ডগোল, এলেন ইয়েলেৎসিন।
ভারতের ইতিহাস সুপ্রাচীন। ভারতীয় সভ্যতাও সুপ্রাচীন। মোগল সাম্রাজ্য, তার পর ব্রিটিশরাজ, তার পর স্বাধীন ভারতের পথ চলা। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার দেখিয়েছেন, মোগল সাম্রাজ্যের ত্রুটি-বিচ্যুতি যা-ই হোক, ভারতে এই দীর্ঘ শাসন এক অখণ্ড বিস্তৃত কিন্তু কেন্দ্রীভূত ভারত নামক এক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। সম্রাট অশোক যেমন একদা অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন, ঠিক সে ভাবে আকবরও সম্ভব করেছিলেন। আর এই দু’টি ক্ষেত্রেই ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভাবনার বহুত্ববাদকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছি। দারার মুসলিম ধর্ম পরিত্যাগ না করেও উপনিষদ পড়া এবং তা অনুবাদ করা খুব ছোট ঘটনা নয়।
বৃটিশ জমানাতেও প্রশাসনিক দক্ষতার বিশ্লেষণ এখন নানা দিক থেকে হচ্ছে। যদুনাথ সরকারের রচনা থেকেও জানছি, মোগল সম্রাটদের নিযুক্ত গোয়েন্দা রাজকর্মচারী ছিলেন, তারা নিয়মিত প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে রাজকর্মচারীরা ঘুষ নিচ্ছেন কি না তা জানাতেন। ব্রিটিশ জমানাতেও, এমনকী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনেও গোয়েন্দাবিভাগ ছিল খুব কার্যকর।
কাজেই এক দিকে প্রজাবৎসল রাজা, অন্য দিকে প্রশাসনিক দক্ষতা-এই দুই-ই প্রয়োজন। প্লেটোর রিপাবলিকের কথোপকথনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের দু’টি ধর্ম, প্রথমত- মিতাচার আর দ্বিতীয় ন্যায়। মিতাচার হচ্ছে আনন্দ আর আকাঙ্খাকে শৃঙ্খলায় আনা বা নিয়ন্ত্রণ করা। রাজা চাকরও বটে, আবার চাকরদের কর্তাও বটে।
সুষমা স্বরাজকে নিয়ে বিতর্ক। রাজাকে জবাব দিতে হবে। রাজা নীরব কেন? মায়ানমার নিয়ে নিজের ঢাক নিজে পেটাবেন না বলছেন প্রাক্তন সেনাপ্রধানেরা। রাজা নীরব কেন? এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর যদি মানুষের মনে আসে অসন্তোষ, জাগে প্রশ্ন, তবে তার উত্তর দিতে হবে রাজাকেই। বিশু জবাব দেবে না, নন্দিনীর ও দায় নেই, দায় কিন্তু রাজার। গণতন্ত্রের দাবি, অদৃশ্য রাজাকে সত্যিকারের দৃশ্যমান হতে হবে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নয়।
জয়ন্ত ঘোষাল: নয়া দিল্লি ব্যুরো চিফ, আনন্দবাজার পত্রিকা