কলকাতায় কঙ্কাল: অনর্থের মূলে কি অর্থই

SHARE

মেয়ের মৃত্যুর কথা কি জানতেন না বৃদ্ধ বাবা?

৩ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের তিনতলার বিভিন্ন ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া একের পর এক চিরকুট ঘেঁটে ক্রমে এই ধারণাই দৃঢ় হচ্ছে গোয়েন্দাদের মনে৷ বুধবার গভীর রাতে অরবিন্দ দের অগ্নিদগ্ধ দেহ উদ্ধারের পাঁচ দিনের মাথায়, রোববার এমনই ইঙ্গিত মিলেছে লালবাজার সূত্রে৷ ৭৭ বছরের অরবিন্দ মেয়ে দেবযানীর মৃত্যুর খবর অনেক পরে পেয়েছিলেন বলেও বিভিন্ন সূত্র মারফত জেনেছে পুলিশ৷ আর এই তথ্যই ধন্দ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে তদন্তকারীদের৷ কারণ সম্পত্তি বিক্রির জন্য সলিসিটর সুবীর মজুমদারের সঙ্গে গত ৮ জুন অরবিন্দ দেখা করেছেন, তখনও ছেলেমেয়ে দু-জনের কথাই বলেছিলেন বৃদ্ধ৷ সংবাদমাধ্যমের কাছে এ কথা বলেছেন খোদ সুবীরই৷ সে ক্ষেত্রে দেবযানীর মৃত্যু ঠিক কবে হয়েছে, ৩ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের বাড়িতেই (পাভলভ হাসপাতালে চিকিত্সােধীন পার্থ দে বারবার যা দাবি করেছেন) তার মৃত্যু হয়েছে কিনা অথবা দেবযানীর মৃত্যুর খবর অরবিন্দ কবে জেনেছিলেন, সে সব নিয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু করেছে শেক্সপিয়র সরণি থানা৷

দেবযানীর মৃত্যু প্রসঙ্গে পার্থ যে সব কথা পুলিশকে বলেছেন, তাকে কেন্দ্র করেও নতুন ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে তদন্তকারীদের মনে৷ সেই সঙ্গে পার্থ-দেবযানীর কাকা অরুণ রোববার যে ভাবে জিজ্ঞাসাবাদে একের পর এক কথা বলেছেন, তাতেও বিস্মিত হতে হয়েছে পুলিশকে৷ পার্থ ও অরুণের স্ববিরোধী বক্তব্য সন্দেহ আরও বাড়িয়েছে লালবাজারের৷ পার্থ প্রকৃতই মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন নাকি সচেতন ভাবে তাকে ধীরে-ধীরে বিকারগ্রস্ত করে তোলা হয়েছিল, তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ৷

তবে রবিনসন স্ট্রিট থেকে উদ্ধার হওয়া কঙ্কাল দেবযানীরই কি না, ঘটনার পাঁচদিন পরও সে ব্যাপারে নিশ্চিত হচ্ছে না পুলিশ৷ শুধু তাই-ই নয়, পার্থ ওই বাড়িতে সময় কাটাতেন বলে দাবি করলেও তিনি অন্য কোনো জায়গায় থাকতেন কি না স্পষ্ট নয় তা-ও৷ দেবযানী যে আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেটির সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে অবশ্য এখনই কিছু ভাবেনি লালবাজার৷ অরবিন্দ যে আত্মহত্যা (যদি সত্যিই তার মৃত্যু আত্মহত্যা হয়ে থাকে) করতে পারেন, এমন কোনো ইঙ্গিত তিনি কখনও পাননি বলেও দাবি পার্থ-দেবযানীর কাকার৷ অরবিন্দর আত্মহত্যার পিছনে কারও প্ররোচনা অথবা ‘শক’ রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা৷ আচমকা মেয়ের ‘মৃত্যু’র খবর জানতে পেরেও তিনি আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারেন, এমন সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ৷ এ দিকে, ওই বাড়িতে কোনো ফাঁকা জায়গা আছে কি না, শুরু হয়েছে তার খোঁজও৷ দেবযানীর মৃতদেহ অন্য কোথাও লুকিয়ে অনেক পরে অরবিন্দকে জানানোর মতো ঘটনা ঘটে থাকতে বলেও মনে করছেন কেউ-কেউ৷ দেবযানীর নাম করে পার্থ চিরকুট লিখতেন অথবা লিখতে ‘বাধ্য’ হতেন কিনা, খতিয়ে দেখা হচ্ছে এই সম্ভাবনাও৷

বুধবার মাঝরাত ও বৃহস্পতিবার সকালে পার্থ পুলিশকে জানিয়েছিলেন, মে মাসে তার জন্মদিনে অরুণরা তার বাড়িতে এলে তিনি তাদের তাড়িয়ে দেন৷ পুলিশের দাবি, অরুণ ও তার ছেলে অর্জুন এ দিন জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, সে দিন অরবিন্দদের বাড়িতে গিয়েছিলেন তারা৷ জন্মদিনের কেক কাটা থেকে শুরু করে সে দিনের বেশ কিছু দৃশ্যের কথা এ দিন তদন্তকারীদের জানিয়েছেন অরুণ৷ সুবীরও গত শুক্রবার ‘এই সময়’-কে জানান, জন্মদিনে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে তাকে মোবাইলে ফোন করেছিলেন পার্থ৷ কিন্ত্ত পরে অরবিন্দ তাকে সাফ বলে দেন, পার্টিতে আসতে হবে না৷ সে ক্ষেত্রে পার্থ সত্যি কথা বলছেন না তার কাকা অরুণ, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইছে পুলিশ৷ এ দিন এই সংশয়ের প্রশ্নের উত্তরে অরুণ বলেছেন, ‘প্রমাণ হয়ে গেল জন্মদিনের পার্টিতে আমি গিয়েছিলাম৷’ কিন্ত্ত কী ভাবে তা প্রমাণ হল অথবা কেনই বা তার প্রমাণ করার চেষ্টা, সে নিয়ে কিছু বলেননি তিনি৷

পুলিশের দাবি, এ দিনের জিজ্ঞাসাবাদে অরুণ জানিয়েছেন, আমেরিকায় থাকাকালীন মস্তিস্কে কোনো গুরুতর সমস্যা হয় পার্থর৷ তার ভাইপো ‘অ্যান্টি-ডিপ্রেসান্ট ড্রাগ’ বা মানসিক অবসাদরোধী ওষুধ খেতেন বলেও জানিয়েছেন অরুণ৷ যদিও পার্থ জেরায় পুলিশকে তেমন কথা জানাননি৷ ছেলে সম্প্রতি সেই ওষুধ খাওয়া থামিয়ে দেয় বলেই পার্থর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা খারাপ হচ্ছিল, অরবিন্দ তাকে এ কথা জানিয়েছিলেন বলেও দাবি করেন অরুণ৷ যদিও মেয়ে দেবযানীর ব্যাপারে অরবিন্দ তাকে কিছু বলেছিলেন কি না, তা নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি তিনি৷ তার দাবি, বুধবার গভীর রাতেই তিনি প্রথম দেবযানীর কঙ্কালের কথা জানতে পারেন৷ এবং দেবযানীর এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর জানতে পেরে তিনি অত্যন্ত শোকাহত হয়েছেন বলে তদন্তকারীদের জানিয়েছেন অরুণ৷

অরবিন্দ ও তার একটি জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের কথা পুলিশকে বলেছেন অরুণ৷ এই ব্যাপারটিও ভাবিয়েছে পুলিশকে৷ ওই জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের তথ্য উঠে এসেছে পুলিশি তদন্তেও৷ মা শান্তিদেবীর মৃত্যুর পর ভাড়াটের মাসিক ভাড়ার টাকা ওই অ্যাকাউন্টেই জমা পড়ত বলে প্রাথমিক তদন্তে জেনেছে পুলিশ৷ একটি অংশ পেতেন অরবিন্দ, আরেকটি অংশ পেতেন অরুণ৷ কে, কত অংশ পেতেন তা এখনও স্পষ্ট নয়৷ তবে পার্থ, দেবযানী ও অরবিন্দর চারটি অ্যাকাউন্টে যে লাখ ১২ টাকা রয়েছে, খোঁজ চলছে তার ‘সোর্স’-এর৷ তবে এটিএম থেকে অরবিন্দই নিয়মিত টাকা তুলতেন বলে প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ৷ ওই বাড়িতে কাজ করতে আসা এক ইলেকট্রিশিয়ান, চালক-সহ চার ব্যক্তির খোঁজ পেয়েছেন তদন্তকারীরা৷ তিনটি মোবাইলের মধ্যে যেটি সুইচড অফ ছিল, সেটিও পার্থর বলেই তদন্তে জেনেছে পুলিশ৷