পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার আপত্তিতেই শেষ মুহূর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরসঙ্গীর তালিকা থেকে বাদ পড়েন আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও মিজোরামের চার মুখ্যমন্ত্রী। দিলি্লতে একজন সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে এ তথ্য দিয়েছেন। এদিকে ঢাকা সফরে সফরসঙ্গী না করায় টুইটবার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। টুইটবার্তায় তিনি লেখেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে ভূমি হস্তান্তর, ঢাকা-শিলং-গৌহাটি বাস পরিসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করেছেন। অথচ উত্তর-পূর্বের কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি সফরসঙ্গী করেননি। এতে স্পষ্ট হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেন না।’ স্থানীয় একটি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলেন, শুধু মমতাকে সফরসঙ্গী করা প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। ঢাকারসূত্র জানায়, মোদির সফরের দিন-তারিখ ঠিক করা নিয়ে আলোচনার শুরুতে পশ্চিমবঙ্গসহ পাঁচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সফরসঙ্গী হিসেবে থাকতে পারেন বলে জানানো হয়েছিল। সে হিসেবে ঢাকা প্রস্তুতিও রেখেছিল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি সফরে আসার চার দিন আগে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া আর কোনো মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরসঙ্গী হচ্ছেন না। কেন তারা আসছেন না, সে ব্যাপারে ঢাকার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই বলেই সূত্র জানায়। সূত্রের মতে, এটা ভারতের নিজস্ব ব্যাপার, এ নিয়ে ঢাকার কিছু বলার নেই।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোর একজন মুখ্যমন্ত্রীও তার সফরসঙ্গী না হওয়ায় বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। শুরু থেকেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমা ও মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালথানওয়ালার সফরসঙ্গী হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছিল। দিলি্লর সরকারি সূত্রগুলোও এ তথ্য নিশ্চিত করেছিল; বরং অনিশ্চয়তা ছিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার সফরসঙ্গী হওয়া নিয়েই। অথচ শেষ পর্যন্ত একমাত্র তিনিই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরসঙ্গী হিসেবে ঢাকা গেলেন এবং স্থল সীমান্ত চুক্তির দলিল হস্তান্তরসহ কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা ও ঢাকা-শিলং-গৌহাটি বাস সার্ভিসের উদ্বোধনেরও সাক্ষী থাকলেন। নরেন্দ্র মোদি দিলি্ল ফিরে আসার পর থেকেই চার মুখ্যমন্ত্রীর শেষ মুহূর্তে সফরসঙ্গী না হওয়া নিয়ে জোর সমালোচনা আর জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে দিলি্লতে এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ২০১১ সালে তখনকার প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং যেমন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে তার সফরসঙ্গী করেছিলেন, তেমনি নরেন্দ্র মোদিও চার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সফরসঙ্গী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এবার তাতে বাদ সাধেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাকে সফরসঙ্গী করতে হলে আর কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সফরসঙ্গী করা যাবে না, এমন আজগুবি শর্ত দেন। তার এই শর্ত পূরণেই শেষ মুহূর্তে সফরসঙ্গীর তালিকা থেকে চার মুখ্যমন্ত্রীকে বাদ দেওয়া হয়।
দিলি্লর সূত্র জানায়, ঢাকা সফরের আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে তিনটি শর্ত দেন। এগুলো হচ্ছে_ ঢাকা সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করা যাবে না, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক বিমানে নয়, তিনি এককভাবে ঢাকা যাবেন এবং এ সফরে তিনি ছাড়া অন্য কোনো মুখ্যমন্ত্রীকে সফরসঙ্গী করা যাবে না। দিলি্লর সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া বিকল্প পথ ছিল না। কারণ, কাঠমান্ডুতে গত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি যখন ঢাকা যাবেন, অবশ্যই মমতাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। আর একটি বিষয় ছিল, ড. মনমোহন সিং মমতাকে সফরসঙ্গী করতে পারেননি, সে ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি মমতাকে সফরসঙ্গী করে তার নেতৃত্বের সফলতা প্রমাণেরও চেষ্টা করেন। এর ফলে চারজন মুখ্যমন্ত্রীকে সফরসঙ্গীর তালিকা থেকে বাদ দিয়েও তিনি মমতার শর্তে রাজি হয়ে যান।
এদিকে এ সফর নিয়ে আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ এবং ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার প্রকাশ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করেছেন। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের আগে নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিলেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী কাউকেই সময় দেননি। মমতাকে সফরসঙ্গী করার বিষয়টি ‘রাজনৈতিক সুবিধাবাদ’ ছাড়া কিছুই নয়। আর আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ অপর একটি টুইটবার্তায় লিখেছেন, উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ তৈরি করতে এসব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সহযোগিতা প্রয়োজন। এটা যেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভুলে না যান।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মতোই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর অবস্থানও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি ও সমঝোতাগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও এসব রাজ্যের সহযোগিতা প্রয়োজন। এখানকার সাতটি রাজ্যের মধ্যে নাগাল্যান্ড ছাড়া সবক’টি রাজ্য বিজেপিবিরোধীদের হাতে। চারটিতে রাজ্য সরকারে আছে কংগ্রেস, ত্রিপুরায় আছে বামফ্রন্ট। এসব রাজ্যের অধিকাংশ মুখ্যমন্ত্রীই মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী মোদির সংকীর্ণ রাজনীতির বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হলেও তারা বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করতে দিতে চান না। কংগ্রেসের মুখপাত্র আনন্দ শর্মা উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছেন। গত সোমবার কংগ্রেস সদর দপ্তরে সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসশাসিত রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে সভা করেন। সেখানে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চারটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন। তারা প্রত্যেকেই প্রধানমন্ত্রী মোদির ঢাকা সফরে তাদের উপেক্ষা করার সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেন বলে সভা সূত্র জানায়।
প্রধানমন্ত্রী মোদির বাংলাদেশ সফরে যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দু’দেশের সম্পর্ক উন্নত করার জন্য যে রূপরোখা দেওয়া হয়েছে, তার সাফল্য নির্ভর করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। জলবিদ্যুৎ থেকে সড়ক যোগাযোগসহ উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ-ভারত সমঝোতা বাস্তবায়নে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সহযোগিতা আদায় করাই হবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রধান চ্যালেঞ্জ।