বেড়েছে আকার, নেই নতুনত্ব

SHARE

১৯৭২ থেকে ২০১৪ স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রার ৪৩ বছর। একই সঙ্গে রচিত হতে যাচ্ছে ৪৩টি জাতীয় বাজেট উত্থাপনের ইতিহাস। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এর আকার দাঁড়াচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা।

অতীতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি), উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয়, কর, আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), ঘাটতি এবং বিদেশি ঋণ ও অভ্যন্তরীণ ঋণের ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছে সবকটি বাজেট। এবারও ঠিক তাই। তবে সরকারের দাবি, বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে এবং মহাজোট সরকারের ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নকে সামনে রেখেই প্রণীত হয়েছে চলতি অর্থবছরের বাজেট।image_94292_0.png

দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির লক্ষ্যে প্রতিবছর বাজেট পরিকল্পনা করে সরকার। মানুষের জীবন যাত্রার মান, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনিয়োগ, কৃষি, মৎস্য, খনিজ ও খনন, শিল্পোৎপাদন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানিসম্পদসহ অন্যান্য বিষয়গুলো মাথায় রেখেই এ বাজেট পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা হয়।

স্বাধীনতার পর দীর্ঘসময় পার হয়েছে। পরিবর্তিত হয়েছে জীবন যাত্রার মান ও অর্থনৈতিক অবস্থা। তার ধারাবাহিকতায় পরিবর্তিত হয়েছে বাজেট প্রণয়ন পদ্ধতিও। দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ১০ জন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি সংসদে বাজেট পেশ করেছেন। বর্তমান সংসদে পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সামরিক শাসক এরশাদের আমলে দুইবারসহ এ নিয়ে আটবার বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন মুহিত। তবে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১২ বার বাজেট উপস্থাপন করেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। এছাড়া শাহ এএমএস কিবরিয়া ৬ বার বাজেট ঘোষণা করেন।

বাজেট ২০১৪-১৫

দ্বিতীয় মেয়াদের মহাজোট সরকার দিতে যাচ্ছে আকারের দিক থেকে স্মরণকালের সর্বোচ্চ বাজেট। বৃহস্পতিবার ১০ম সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। নতুন অর্থবছরে বাজেটের সম্ভাব্য আকার হতে পারে ২ লাখ ৫০ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা।

নতুন অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নকে বর্তমান সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও দেশের অর্থনীতিতে এখনও অনিশ্চয়তা ও স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিনিয়োগে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে এবং বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সমঝোতার রাজনীতি প্রয়োজন বলে মনে করেন বাজেট বিশ্লেষকরা।

অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ চাঙ্গা করাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন তারা। আর নতুন সরকারের জন্য সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করাটাই সামনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

জানা গেছে, বিশাল আকারে বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। এতে বাজেটে ঘাটতি থাকবে ৬৭ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। এ ঘাটতি বৈদেশিক ও দেশিয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে মেটানো হবে বলে জানা গেছে। তবে বাজেটের ঘাটতি বাড়ার বড় কারণ এডিপি বলে মনে করছেন বাজেট সংশ্লিষ্টরা। আসন্ন অর্থবছরে এডিপির আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা।

জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে ৮৬ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এতে বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। নিজস্ব সহায়তা ৫২ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও কর্পোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নের ৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকাও এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এডিপির আকার হয়েছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা।

বাজেট ঘাটতি

জানা গেছে, আসন্ন বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ৬৭ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি বাড়ছে ১২ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটানো হবে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। এর মধ্যে বৈদেশিক উৎস থেকে ২৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৪০ হাজার ৭৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ৩১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংক-বহির্ভূত খাত থেকে ৮ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে।

রাজস্ব আয়

২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আয়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের বড় অংশই আসবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে। এ জন্য এনবিআর-এর কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ১৪০ কোটি টাকা এবং কর-বহির্ভূত রাজস্ব আদায় করা হবে ২৭ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরের সামগ্রিক আয় হতে পারে ১ লাখ ৮২ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা।

একনজরে অতীতের ৪২টি বাজেট

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে দিয়ে ১৯৭২ সালে দেশে বাজেটের যাত্রা শুরু। ১৯৭২-৭৩, ৭৩-৭৪ এবং ৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন তাজউদ্দীন আহমেদ। ঐতিহাসিক বাজেটগুলোর আকার ছিল যথাক্রমে ৭৮৬, ৯৯৫ এবং ১০৮৪ কোটি টাকা। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরে এসে বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে আড়াই লাখের কোটায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের আমল:

১৯৭২-৭৩, ৭৩-৭৪ এবং ৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন তাজউদ্দীন আহমেদ। বাজেটগুলোর আকার যথাক্রমে ৭৮৬ কোটি টাকা, ৯৯৫ এবং ১০৮৪ কোটি টাকা। ১৯৭৫-৭৬ সালে ১ হাজার ৫৪৯ দশমিক ১৯ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন ড. আজিজুর রহমান মল্লিক।

জিয়াউর রহমান আমলের বাজেট:

১৯৭৬-৭৭ ও ৭৭-৭৮ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন মে.জেনারেল (অব.) জিয়াউর রহমান। বাজেটের আকার ছিলো যথাক্রমে ১৯৮৯ ও ২১৮৪ কোটি টাকা। রাষ্ট্রপতি হিসেব জিয়াউর রহমান ১৯৭৮-৭৯ সালে ২ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন। এরপর ১৯৭৯-৮০ ড. এম এন হুদা ৩ হাজার ৩১৭ কোটি, ১৯৮০-৮১ ও ৮১-৮২ অর্থবছরে এম. সাইফুর রহমান ৪ হাজার ১০৮ এবং ৪ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকার বাজেট দেন।

এরশাদ আমল:

১৯৮২-৮৩ ও ৮৩-৮৪ অর্থবছরে বাজেট ঘোষণা করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাজেটের পরিমাণ ৪ হাজার ৭৩৮ এবং ৫ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। ১৯৮৪-৮৫, ৮৫-৮৬, ৮৬-৮৭ এবং ১৯৮৭-৮৮ অর্থবছরে এম সায়েদুজ্জামান। বাজেটের পরিমাণ যথাক্রমে ৬ হাজার ৬৯৯, ৭ হাজার ১৩৮, ৮ হাজার ৫০৪ এবং ৮ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা। ১৯৮৮-৮৯তে মে. জেনারেল (অব.) মুনিম ১০ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা, ১৯৮৯-৯০তে  ড. ওয়াহিদুল হক ১২ হাজার ৭০৩ কোটি, ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে আবার মে. জেনারেল (অব.) মুনিম ১২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন।

১৯৯১-১৯৯৬ বিএনপি সরকার:

১৯৯১-৯২, ৯২-৯৩, ৯৩-৯৪, ৯৪-৯৫ এবং ৯৫-৯৬ একটানা পাঁচ বছরই অর্থমন্ত্রী হিসেবে এম সাইফুর রহমান সংসদে বাজেট পেশ করেন। বাজেটের আকার যথাক্রমে ১৫ হাজার ৫৮৪, ১৭ হাজার ৬০৭, সাড়ে ১৯ হাজার, ২০ হাজার ৯৪৮ এবং ২৩ হাজার ১৭০ কোটি টাকা।

১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগ সরকার:

১৯৯৬-৯৭, ৯৭-৯৮, ৯৮-৯৯, ৯৯-২০০০, ২০০০-০১ এবং ২০০১-০২ অর্থবছরে শাহ এএমএস কিবরিয়া যথাক্রমে ২৪ হাজার ৬০৩, ২৭ হাজার ৭৮৬, ২৯ হাজার ৫৩৭, ৩৪ হাজার ২৫২, ৩৮ হাজার ৫২৪ এবং ৪২ হাজার ৩০৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন।

২০০২-০৬ চারদলীয় জোট সরকার:

২০০২-০৩ থেকে ২০০৬-০৭ টানা পাঁচ অর্থবছরে এম সাইফুর রহমান যথাক্রমে ৪৪ হাজার ৮৫৪, ৫১ হাজার ৯৮০, ৫৭ হাজার ২৪৮, ৬১ হাজার ৫৮ এবং ৬৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন।

সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার:

সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭-০৮ থেকে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অর্থ উপদেষ্টা এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ৯৯ হাজার ৯৬২ এবং ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন।

মহাজোট সরকারের প্রথম আমল:

২০০৯-১০ থেকে ২০১৩-১৪ পাঁচ অর্থবছরের জন্য সংসদে বাজেট পেশ করেন এম এ মুহিত। বাজেটের পরিমাণ ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯, ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭০, ১ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯, ১ লাখ ৬৫ হাজার এবং সর্বশেষ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা।

নতুন মেয়াদে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম বছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে পারে আড়াই লাখ কোটি টাকা। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আকারের বাজেট উপস্থাপন করে আগের মেয়াদে ইতিহাস গড়েছেন তিনি। এবার তার চেয়ে আরও বড় আকার হওয়ায় নতুন করে ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন। তবে বাজেটের আকারের চেয়েও তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিচ্ছেন বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা।