বুধবার সকালে ভারতে গৌহাটির বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে শিলংয়ের দিকে রওনা হওয়ার সময় থেকেই সন্দেহটা দানা বাঁধছিল – পারা যাবে কি সালাউদ্দিন আহমেদের ‘কিডন্যাপিং’ রহস্যের মূলে পৌঁছতে!
মঙ্গলবার থেকেই আন্দাজ করতে পারছিলাম যে মেঘালয় রাজ্যের পুলিশ প্রশাসন মি. আহমেদের ব্যাপারে খুব একটা কথা বলতে চাইছে না।
প্রধান নার্স বা মেট্রনের ঘরে ঢুকলাম – যদি কোনো কথা বার করা যায়।
তারা তো মি. আহমেদ আর তার কিডন্যাপিং – শিলংয়ে হঠাৎ তার আবির্ভূত হওয়া সবকিছু তো ইতিমধ্যেই খবরের কাগজে পড়ে জেনেছেন, তাদের কাছ থেকে আর কি খবর পাওয়া যায় – লক্ষ্য ছিল সেটাই।
কোন্ ডাক্তার চিকিৎসা করছেন, সেটা জানতে পারি? নাহ, “সেটা হাসপাতালের সুপার বলবেন।”
কোন ঘরে আছেন মি. আহমেদ, সেটা দেখা যেতে পারে? সেটা কী হাসপাতাল সুপার বলবেন না পুলিশ সুপার?
পুলিশ সুপারের কাছে গিয়ে যে খুব একটা লাভ নেই, জানি, তাই গেলাম হাসপাতাল সুপারের কাছে।
মি. আহমেদের স্বাস্থ্য কেমন আছে সেটা জানতে চাইলাম, জবাব এল, ‘স্টেবল’ – স্থিতিশীল।
একটা ইন্টারভিউ দেবেন? জবাবে পাওয়া গেল হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের নাম, ফোন নম্বর। “ওনার সঙ্গে কথা বলুন”।
কথা হলো ডাক্তার ডি জে গোস্বামীর সঙ্গে। জানালেন, “বুধবার বেশ কিছু পরীক্ষা করিয়েছি। সব রিপোর্ট আসে নি। তবে ইসিজি প্রায় স্বাভাবিক। মি. আহমেদ পুরনো হৃদরোগের কথা বলেছেন। তাই সেদিকেই নজর বেশি দিচ্ছি। কিডনিরও সমস্যা রয়েছে। কিন্তু কথাবার্তায় অসংলগ্ন কিছু লক্ষ্য করি নি। সেরকম হলে তো আমিই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাকতাম।”
তবে যে পুলিশ বলল তিনি অসংলগ্ন কথা বলছিলেন – তাই মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল? কে দেবে উত্তর!
এরপরের টার্গেট পোলো গ্রাউন্ড এলাকা। সেখানকার প্যাস্তুর পুলিশ চৌকির কর্মীরাই প্রথম মি. আহমেদকে নিয়ে আসেন।
খুঁজে বার করা গেল কয়েকজনকে – যারা সোমবার সকালে ডিউটিতে ছিলেন।
প্রথমে তো কেউ কথা বলতেই রাজি নন। তারপরে যখন আশ্বস্ত করলাম তাদের নাম প্রকাশ করব না, বা ইন্টারভিউ রেকর্ডও করব না, তখন বলতে শুরু করলেন।
এদের কাছ থেকে টুকরো টুকরো যা পাওয়া গেল, তা হল এরকম:
সোমবার ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পোলো গ্রাউন্ডের প্রাতভ্রমণকারীরা ফোন করে খবর দেন যে একজন ব্যক্তি উদভ্রান্তের মতো সেখানে ঘুরছেন।
পুলিশ গিয়ে তাকে প্যাস্তুর চৌকিতে নিয়ে আসে। তিনি নিজের পরিচয় দেন সালাউদ্দিন আহমেদ বলে – এটাও বলেন যে তিনি বাংলাদেশের বিএনপি-র নেতা, প্রাক্তন মন্ত্রী। তাকে মুখোশ পরা কয়েকজন ফেলে রেখে গেছে ওই জায়গায়। তার নিজের মুখও ঢাকা ছিল।
তাহলে প্রশ্ন – তার নিজের মুখ ঢাকা থাকলে মুখোশপরা কয়েকজন তাকে সেখানে ফেলে দিয়ে গেছেন তা তিনি দেখলেন কীভাবে?
পুলিশের বক্তব্য তার মোটামুটি পরিষ্কার পোশাক ছিল আর হাতে একটা প্লাস্টিক ব্যাগে আরও এক সেট জামা- প্যান্ট ছিল, তবে কোনো টাকাপয়সা ছিল না। আর কোনও নথিও নেই। গালে প্রায় দিন ১০-১২-র না-কাটা দাড়ি ছিল।
এই অবধি শুনে পুলিশের প্রথমে বিশ্বাসই হয় নি। ভেবেছিলেন প্রলাপ বকছেন। সেজন্যই মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া।
পুলিশ কর্মকর্তার কাছে আমার প্রশ্ন ছিল দুটো।
এক, শিলং শহরে উদভ্রান্তের মতো কাউকে ঘুরতে দেখলেই কি সাধারণ মানুষ পুলিশে খবর দেয় আর পুলিশও চৌকিতে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করায়?
উত্তর এলো, অত ভোরে কেউ উদভ্রান্তের মতো ঘুরছেন, জায়গার নাম জিগ্যেস করছেন – এসব শুনেই পুলিশ গিয়েছিল।
আর দুই, এটা কতটা তারা নিজেরা বিশ্বাস করেন যে একজন বাংলাদেশী নাগরিককে নিয়ে মুখ ঢেকে সীমান্ত পার করে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে প্রায় আশি কিলোমিটার নিয়ে আসা হলো, অথচ কারও চোখে পড়ল না !
এটা পুলিশের বড়কর্তাদেরও জিগ্যেস করেছি। সবারই উত্তর ছিল, “অসম্ভব, অবাস্তব,”!
তাহলে? কীভাবে বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ সীমান্ত পেরিয়ে অতটা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে শিলংয়ে পৌঁছলেন?
পুলিশের বড়কর্তারা বলছেন, “হাসপাতালে থাকার জন্য ওনাকে জেরাই তো করতে পারি নি আমরা। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না কারা পোলো গ্রাউন্ডে ফেলে গেল। তিনি যেটুকু বলেছেন, সেটা কতটা সত্যি সেটা জানতেও তো দীর্ঘ জেরার দরকার। তারপরে আদালত।”
স্থানীয় দুষ্কৃতিদের মধ্যে যে পুলিশের সোর্স থাকে সেটা জানা কথা। সেখান থেকে কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না?
এখনও কিছু পাওয়া যায় নি – উত্তর এক কর্তার।
অতএব.. যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করেছিলাম, সেটা তো পাওয়া গেলই না, কোনো দিশাও দেখা গেল না দিনের শেষে।
দিশা দেখাতে পারেন যিনি, তার কাছে পৌঁছাবার নিয়ম নেই।– বিবিসি।