ওপরের ছবিটি দেখুন। মনে হতে পারে এক পর্দানশীন তরুণী। ওড়নায় প্রায় পুরো মুখই ঢাকা। দেখা যাচ্ছে শুধু ভয়ার্ত দুটি চোখ। হঠাৎই আলোড়ন তুললেন এই তরুণী। তিনি লাবণ্য হিজড়া। প্রকাশ্য দিবালোকে তরুণ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে পালিয়ে যাচ্ছে তিন উগ্রবাদী তরুণ। সবাই ভীত, হতভম্ব। নিমিষেই ভয়কে জয় করলেন লাবণ্য। পলায়নপর সশস্ত্র ঘাতকদের অসীম সাহসিকতায় জাপটে ধরলেন তিনি। তুলে দিলেন পুলিশের হাতে। তারপরই উধাও লাবণ্য ও তার দুই সঙ্গী নদী ও চকোরি।দারুণ ভয়ে লাবণ্য হিজড়া নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন গত সোমবারের সকালের সেই লোমহর্ষক ঘটনার পর থেকে। সাংবাদিক, পুলিশ সবাই খুঁজছেন তাকে। যেন হাওয়ায় হারিয়ে গেছেন এই সাহসিকা নারী। কিছুতেই তার খোঁজ মিলছিল না। অনেকটা ভয়ে তিনি নিজেকে আড়াল করেছিলেন।
অবশেষে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তার খোঁজ মিলল। লাবণ্যের যিনি ‘সর্দারণী’ সেই ৩৮ বছর বয়সী স্বপ্নার সহায়তায় লাবণ্যের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়া গেল। স্বপ্নার বাসায় তার উপস্থিতিতে শর্তসাপেক্ষে এ প্রতিবেদককে সাক্ষাৎকার দেন লাবণ্য। শর্তগুলোর মধ্যে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, সবাই চেহারা চিনে যেতে পারে এমনভাবে তার ছবি প্রকাশ করা যাবে না। লাবণ্যসহ স্বপ্নার অন্য অনুসারীরা তাকে ‘গুরুমা’ বলেও ডাকেন, যারঅনুমতি মেলার পর সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হন লাবণ্য।লাবণ্যর বয়স ২১। আলাপচারিতার শুরুতে চেহারায় খানিকটা ভয় ও আতঙ্কের ছাপ থাকলেও কিছু সময়ের মধ্যে তা কাটিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বর্ণনা দিলেন ওয়াশিকুর রহমানের দুই খুনিকে ধরে ফেলার নাটকীয় ঘটনার। সোমবার সকালে বাসা থেকে রিকশা করে নদী হিজড়া এবং চকোরি হিজড়ার সঙ্গে তেজগাঁও এলাকার সড়ক ধরে লাবণ্য যাচ্ছিলেন মগবাজারের দিকে। তেজগাঁও সাতরাস্তার কাছাকাছি এক জায়গায় ভীষণ যানজট দেখে তারা তিনজন রিকশা ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন।
লাবণ্যের জবানিতেই শোনা যাক সেই চাঞ্চল্যকর ঘটনা_ ‘এমন সময় পেছন থেকে হৈহুল্লোড় শব্দ শুনি। কারা যেন বলতেছিল, ধর, ধর, ধর, ডাকাত, ডাকাত। পাবলিক বলতেছে, মানুষ মেরে থুয়ে আইছে, ধর, ধর। তখন পেছনে চাইয়া দেখি দাড়িওয়ালা, গেঞ্জি পরা দুইজন আমাদের দিকেই দৌড়াইয়া আসতেছে, তাদের আরও পেছনে কয়েকজন পুলিশ আর পোলাপান দৌড়াইতেছে তাদের ধরার জন্য। আশপাশের পাবলিক কেউ সাহস করে ধরতেছে না। ওরা যখন আমাদের পাশ দিয়া দৌড়াইয়া পার হইছে ঠিক তখন আমি পেছন থেকে দুই হাত দিয়া দুইজনের গেঞ্জি টেনে ধরছি।’
‘ওরা কাকে মারছে আমি তো জানতাম না। আমি ধরার পর একজন আমার হাতে কয়টা কিল-ঘুষি দিল তাদের ছাড়ানোর জন্য কিন্তু পারল না। ওরা আমারে বলল_ ছাড়, ছাড়। আমি তাদের বললাম_ এই চুপ। ওরা একটু থমকাইয়া আমাদের তিনজনের দিকে তাকাইয়া দেখতেছিল। একজনের হাতের ব্যাগ থেকে তখন একটা চাপাতি রাস্তায় পইড়া গেল। এর মধ্যেই পুলিশ আর পাবলিক যারা দৌড়াইতে ছিল ওরা চইলা আসছে আমাদের কাছে। পুলিশ আমার হাত থেকে ওই দুইজনকে নিয়া গেল। যাবার সময় আমাকে পুলিশ আর পাবলিক বলে গেল, তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়া হলো ধরার জন্য’_ যেন এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন লাবণ্য।তারপর তিনি নদী আর চকোরির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ‘সর্দারণী’ স্বপ্নার কাছে গেলেন, তাকে ঘটনাটা বললেন। নদী আর চকোরিও নিশ্চিত করেছেন তারা পাশে থাকলেও সন্ত্রাসীদের ধরার কাজটা লাবণ্য একাই করেছে।’মনে মনে আমি ভয় পাইছি, এটা কী করলাম! আমি ভয়ে দেশে (গ্রামের বাড়ি) চলে যেতে চাইছি। কিন্তু সর্দারণী বলছেন, চিন্তা করিস না। কাউকে কিছু বলিস না, আমি বুঝব, ভয় নাই, তুই থাক ঢাকায়’_ বললেন লাবণ্য।পরে যখন আরও জানতে পেরেছেন ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তখন যেমন ভয় হয়েছে, ভালোও লেগেছে তার। কারণ অনেক হিজড়া তার প্রশংসা করেছেন, পাশাপাশি তাকে চেনেন না এমন সাধারণ মানুষের মুখে হিজড়াদের সন্ত্রাসী ধরে দেওয়ার ঘটনার প্রশংসাও শুনেছেন।লাবণ্য বলেন, ‘আমার ভালো লাগছে, আমি খুনি, সন্ত্রাসী ধরে দিছি। এরপর যখন বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে টাকা কালেকশন করতে গেছি তখন আমাদের দেখে অনেকে বলেছে, তোরা ভালো কাজ করে দিছিস, দেশের সন্ত্রাসীদের ধরে দিছিস।’
আরও অনেক দরিদ্র, অবহেলিত, বঞ্চিত হিজড়ার মতোই লাবণ্য দল বেঁধে হেঁটে শহরে ঘুরে মানুষের কাছে হাত পেতে টাকা সংগ্রহ করেন বেঁচে থাকার জন্য। লাবণ্যের ভয়, ওয়াশিকুরের ওই দুই খুনিকে ধরবার সময় যদি খুনিদের দলের কেউ তাকে দেখে থাকে এবং তার চেহারা মনে রাখে তাহলে তাকে আক্রমণ করে মারবার জন্য চেষ্টা করতে পারে তারা।’আমি নিরাপত্তা চাই। আমরা যেন ভালোভাবে চলতে পারি, কোনো বিপদ যেন না আসে,’_ লাবণ্য বললেন, ‘আমি যে সন্ত্রাসী ধরে দিছি এই জন্য আমার পুরস্কার পাওয়া উচিত। শুধু আমি না, আমার এই কাজের জন্য হিজড়ারা আজ গর্বিত।’লাবণ্য ৯ বছর বয়সে তার এক অগ্রজ হিজড়ার সঙ্গে বাড়ি থেকে চট্টগ্রাম চলে যান। সেখানে ৭ বছর থাকার পর চলে আসেন ঢাকায়। অনেক দুঃখ, কষ্ট আর ক্ষোভের কথা বললেন লাবণ্য_ ‘মাঝে মধ্যে ঘিন্না লাগে। কারণ হিজড়া বলে মানুষ আমাদের খারাপ চোখে দেখে। হিজড়াদের কাছে কেউ ঘর ভাড়া দিতে চায় না। আমরা কোনো অফিস বা কারও বাসায় গেলে গেট থেকেই আমাদের ‘যাও, যাও’ বলে তাড়াইয়া দেয়। তবে কিছু মানুষ আছে তারা ভালোবাসে আমরা অসহায় বলে, বঞ্চিত বলে।’ লাবণ্য মনে করেন ২০১৩ সালে সরকার হিজড়াদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, হিজড়া পরিচয়ে ভোটার হবার, সব করবার অধিকার দিয়েছে, কিন্তু মানুষ তাদের গ্রহণ করতে চায় না। তাই তার চাওয়া সরকার হিজড়াদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করলে তাদের আর মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে হতো না।
ওয়াশিকুরের যে অভিযুক্ত খুনিদের লাবণ্য ধরেছেন তাদের ধরার জন্য প্রথম দক্ষিণ বেগুনবাড়ীর গলি থেকে যিনি তাড়া করে আসছিলেন এবং টহল পুলিশকে পথে পেয়ে ধরার জন্য বলেছিলেন তিনি ৩৫ বছরের একজন ড্রাইভার রফিক হোসেন। গত মঙ্গলবার তার সঙ্গে কথা বলবার সময় তিনিও বলেছিলেন হিজড়াদের সহায়তা না পেলে খুনিদের ধরা কঠিন হতো। তেজগাঁও শিল্প এলাকা থানা পুলিশের সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর শাহীন মিয়া হাতে রাইফেল নিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দৌড়ে তাড়া করেছেন তিনজন (একজন পালাতে সক্ষম হয়) সন্দেহভাজন খুনিকে ধরতে। তিনিও বললেন, হিজড়াদের ভূমিকার কারণে তাদের গ্রেফতার করতে সুবিধা হয়েছে।পুলিশের তেজগাঁও এলাকার উপকমিশনার বিপ্লব সরকার বৃহস্পতিবার রাতে এই প্রতিবেদককে ফোনে বলেন, তিনি হিজড়াদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যে হিজড়ারা সন্ত্রাসীদের ধরে দিয়েছেন তাদের খোঁজ জানতে চেয়েছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে কোনো বিপদ হতে পারে এই ভয়ে হিজড়ারা নিজেদের প্রকাশ করতে চাইছেন না বলে তার মনে হয়েছে।’যে হিজড়ারা ওই দুইজনকে ধরে দিয়েছে তাদের সন্ধান পেলে আমরা তাদের পুরস্কৃত করব,’ বললেন পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব সরকার।