দিনে গড়ে ১৫ খুন

SHARE

marder15সারা দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বেড়েই চলছে খুনের ঘটনা। পারিবারিক ও তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন খুনের ঘটনা ঘটছে, তেমনি রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়েও প্রতিপক্ষকে খুন করা হচ্ছে নির্মমভাবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ব্যস্ত থাকায় সুযোগ নিচ্ছে সন্ত্রাসীরাও। সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৪ থেকে ১৫ জন খুন হচ্ছেন। পাল্টেছে খুনের ধরনও। আগের চাইতে আরও বেশি নির্মমতা দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ের একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সন্ত্রাসীরা সুযোগ নিচ্ছে। এছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক বন্ধনেও চিড় ধরেছে। অর্থনৈতিক কারণেও ঘটছে খুনের ঘটনা। এ সবের মূল কারণ হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হওয়া। অপরাধ করে পার পাওয়া যায় বা অর্থ দিয়ে সব ‘ম্যানেজ’ করার সংস্কৃতি চালু হওয়ায় মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা আশঙ্কাজনকহারে বেড়েই চলছে। এর প্রতিকার করতে হলে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, সমাজে অস্থিরতা থাকলে খুন-খারাবি বাড়ে। এর অন্যকোন কারণ নেই। আর বেশির ভাগ খুন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হয় বলে আগে থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তা ঠেকানোর সুযোগ নেই। তবে যেটি করতে হবে তা হলো, খুনের তদন্ত সঠিক ও দ্রুততম সময়ে করে প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক দিনে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কয়েকটি নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) উপ-পরিচালক সীতাংশু শেখর বিশ্বাসের পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলা চালায় এক দুর্বৃত্ত। শীতাংশুর স্ত্রী কৃষ্ণা কাবেরী মণ্ডলকে পিটিয়ে হত্যার পর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। এ ঘটনায় ওই দম্পতির দুই মেয়েও আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এর একদিন আগেই তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন দক্ষিণ বেগুনবাড়ী এলাকায় ওয়াসিকুর রহমান বাবু নামে এক ব্লগারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হামলাকারীরা বাবুর মাথায় চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। যাতে তার চেহারাই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া গত মঙ্গলবার সকালে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় নিজ বাসায় সূর্যি বেগম (৭৫) ও মাফিয়া বেগম (৫০) নামে মা-মেয়েকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তাদের দুজনের মাথাসহ শরীরজুড়ে অসংখ্য ধারালো অস্ত্রের গুরুতর জখম ছিল।

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে হাসপাতালে নেয়ার আগেই তারা মারা যান বলে জানিয়েছে স্থানীয় থানার পুলিশ। ২৯শে মার্চ টাঙ্গাইলের গোপালপুরে এক পাষণ্ড ছেলে তার বৃদ্ধা মাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। গত ২৪শে মার্চ রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে নিজ বাসায় খুন হন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুসের বৃদ্ধা স্ত্রী রওশন আরা বেগম ও গৃহকর্মী কল্পনা। মাত্র দশ হাজার টাকা চেয়ে না পেয়ে বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে রওশন আরা বেগমকে গলা কেটে হত্যা করে সাঈদ নামে ওই বাসার গৃহকর্মীর ছেলে। হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখে ফেলায় ঘাতক সাঈদ তার আপন বোন কল্পনাকেও গলা কেটে হত্যা করে। এর আগে গত ১০ই মার্চ রাজধানীর ফকিরাপুলে সুমি নামে এক তরুণীকে হত্যার পর সাত টুকরা করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। এছাড়া নিহত তরুণীর পরিচয় যেন শনাক্ত না হয় এজন্য তার মাথা ও মুখমণ্ডল পুড়িয়ে চেহারা বিকৃত করা হয়। ১১ই মার্চ সিলেটে আবু সাঈদ নামে নয় বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রকে অপহরণের পর শ্বাসরোধ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় পরে এক পুলিশ সদস্যেরও জড়িত থাকার প্রমাণ পায় তদন্তকারীরা। এছাড়া একদিন আগে ৯ মার্চ বনানীতে বাসের ভেতর ফেলে যাওয়া একটি ট্রাভেল ব্যাগের ভেতর থেকে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত মাসের ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র পাশে শ’ শ’ মানুষের সামনেই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ব্লগার ও বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক ড. অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপায় দুর্বৃত্তরা। এতে অভিজিৎ রায় মারা গেলেও প্রাণে বেঁচে যান বন্যা। বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা হয়।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। চিড় ধরছে সামাজিক বন্ধনেও। মানুষ হয়ে উঠছে ভোগবাদী। কমছে মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ। এ কারণে তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে একে-অপরকে নৃশংসভাবে খুন করতেও দ্বিধা করছে না। স্বামীর হাতে স্ত্রী কিংবা স্ত্রীর হাতে স্বামী যেমন খুন হচ্ছেন, তেমনি বাবা-মা খুন করছেন নিজের সন্তানকে আবার সন্তানের হাতেও খুন হতে হচ্ছে মা-বাবাকে। ভাইয়ের হাতে ভাই আর আত্মীয়ের হাতে আত্মীয় খুন হওয়ার ঘটনা এখন হরহামেশাই ঘটছে। একই সঙ্গে দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যরা। খুনের ধরনও দিনকে দিন পাল্টে যাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত নৃশংস খুনের ঘটনা বেড়েই চলছে। হত্যার পর লাশ টুকরো করে ফেলা বা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা এবং গলা কেটে হত্যার সংখ্যা বেড়েই চলছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং সামাজিক অস্থিরতার কারণে মানুষ এমন নৃশংস হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে সমাজে অপরাধ কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। সমাজে ভারসাম্য বজায় না থাকলে যারা বঞ্চিত তাদের মধ্যে ‘ক্রুয়েলটি’ বেড়ে যায়। এজন্য সমাজে ভারসাম্য বজায় রাখাটা খুবই জরুরি। তিনি বলেন, আইন ও বিচার ব্যবস্থা এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে খুনের মতো বড় অপরাধ করে কেউ আইনের ফাঁক-ফোকর গলে বেরিয়ে যেতে না পারে। একই সঙ্গে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, খুনের ঘটনা বাড়ার অন্যতম কারণ হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। খুন করে কেউ একজন পার হয়ে যাওয়া মানে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। তাকে দেখে অন্যরা উৎসাহিত হয়ে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় দরে বিচারকার্য চলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য বা স্বজনেরাও একসময় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাসী বা দুর্বৃত্তরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যায়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক ও পারিবারিক কারণে নৃশংস খুনের সংখ্যা বাড়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে। একমাত্র আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই এসব খুন-খারাবি ঠেকানো সম্ভব। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, খুনের ঘটনার পরও দায়ী ব্যক্তিরা রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতা আর অর্থ দিয়ে ‘ম্যানেজে’র মাধ্যমে পার পেয়ে যাচ্ছে। এ রকম একটি ঘটনাও ঘটলে সেটি অন্যদের মধ্যে দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। অন্যরা উৎসাহিত হয় যে, খুন করেও ‘শক্ত খুঁটি’ থাকলে পার পাওয়া যায়। এজন্য অপরাধ বিশেষজ্ঞরা খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দিয়েছেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এ পাঁচ বছরে সারা দেশে ২০ হাজার ৯৭৫ জন খুন হয়েছেন। শুধু চলতি বছরের গত তিন মাসে সারা দেশে আরও অন্তত হাজার খানেক খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১০ সালে সারা দেশে ৩ হাজার ৯৮৮ জন, ২০১১ সালে ৩ হাজার ৯৬৬ জন, ২০১২ সালে ৪ হাজার ১১৪ জন, ২০১৩ সালে ৪ হাজার ৩৯৩ জন ও ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫১৪ জন খুন হয়েছেন। এই হিসাবে সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৪-১৫ জন খুন হচ্ছেন। ডিএমপির হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচবছরে রাজধানী ঢাকাতেই খুন হয়েছেন ১ হাজার ৪২৪ জন। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই খুনের সংখ্যা অর্ধশতক পেরিয়ে গেছে। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে খুন-খারাবির ঘটনা ঠেকানোর চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু পারিবারিক কলহের জের ধরে সংগঠিত হওয়া খুন ঠেকাতে হলে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। এছাড়া আসামিদের গ্রেপ্তারের পর দ্রুত বিচারকার্য শেষ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।