রাজশাহীর হজরত শাহ মখদুম বিমানবন্দরে একটি সেসনা-১৫২ মডেলের প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। বিধ্বস্ত বিমানে দগ্ধ হয়ে নারী প্রশিক্ষণার্থী তামান্না রহমান হৃদি (২২) ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। আরেকজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে রাজশাহী সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে বিকাল সাড়ে ৪টায় তাকে একটি ক্যারাভ্যান বিমানে করে ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বিধ্বস্ত প্রশিক্ষণ বিমানটি বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি অ্যান্ড সিভিল অ্যাভিয়েশন লিমিটেডের। প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত তামান্না রহমান প্রশিক্ষণার্থী পাইলট ছিলেন। একদিন আগেই গত বুধবার তিনি সলো (এককভাবে বিমান উড্ডয়নের) অনুমতি পান। নিয়ম অনুযায়ী তিনি ১৫০ ঘণ্টা এককভাবে বিমান উড্ডয়নের পর পাইলট হিসেবে ল্যাইসেন্স পাওয়ার আবেদন করতে পারতেন। অপর আহত লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাহেদ কামাল (৫০)। তার শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
সিভিল অ্যাভিয়েশনের একটি সূত্র জানায়, প্রশিক্ষণ বিমানটি ১টা ৫৫ মিনিটে উড্ডয়ন করে। এর তিন মিনিট পরই বিমানটি বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে ১৫-২০ হাত দূরে ছিটকে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে এতে আগুন ধরে যায়। এ সময় বিমান বিধ্বস্তের শব্দ শুনে রানওয়ের সীমানা প্রাচীরের পাশে চালিকিপাড়া এলাকার ডাবলু ও অটোরিকশা চালক লুৎফুর দেয়াল টপকে রানওয়ের ভেতরের এলাকায় প্রবেশ করে বিমানের আগুন থেকে প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেন সাহেদ কামালকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। পরে খবর পেয়ে বিমানবন্দরে ফায়ারসার্ভিসের গাড়ি গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে এরআগেই আগুনে বিমানটির ককপিট, পাখা, ইঞ্জিন, মূল কাঠামো পুড়ে যায় এবং বিমানটির সামনের চাকা ছিটকে প্রায় ২০ হাত দূরে পড়েছিল। এ ছাড়া বিমানটি যে স্থানে আছড়ে পড়েছে সেখানে মাটি দেবে গিয়ে গর্তের সৃষ্টি হয়।
গতকাল সরজমিনে গিয়ে কথা হয় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ডাবলু, লুৎফর ও আনারুলের সাথে। এর মধ্যে প্রত্যক্ষদর্শী ডাবলু মানবজমিনকে বলেন, বিমানবন্দরের সীমানা প্রাচীরের পাশে গমের ক্ষেত থেকে গম তুলতে এসেছিলেন। এ সময় বিমানটি আকাশে চক্কর দিচ্ছিলো এবং রানওয়ে নামার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে বিকট শব্দ পেয়ে তিনি সীমানা প্রাচীরে উঠে দেখেন বিমানটির একটি পাখা রানওয়ের পাশের মাটিতে ধাক্কা খেয়ে সামনের চাকা ভেঙে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে বিমানটি আছড়ে পড়ে আগুন ধরে যায় এ সময় বিমানের কাচ ভেঙে এক ব্যক্তি বেরিয়ে তাদেরকে বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করে। ডাবলু ও আরও দুইজন প্রাচীর থেকে নেমে তাকে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে বলেন। কিন্তু তারা বিমানে আটকে পড়া নারী পাইলটকে আর বাঁচাতে পারেননি। কেননা বিমানটিতে চারদিক থেকে আগুন ঘিরে ফেলে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফায়ারসার্ভিসের গাড়ি প্রায় ২০ মিনিট পরে আসে। আগে গাড়ি এলে মৃত নারীকে বাঁচানো যেত। তাদের চোখের সামনেই তিনি মারা গেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহত পাইলটের সহকর্মী মানবজমিনকে বলেন, বিমানবন্দরে যে ফায়ারসার্ভিসের (সিভিল বিভাগ) গাড়ি থাকে তা প্রায় নষ্ট। সামনে (৭ এপ্রিল) ঢাকা রুটে বাণ্যিজিক বিমান চলাচলের কথা রয়েছে। এতে সংকট আরও বাড়বে। তিনি ফায়ারসার্ভিসের গাড়ি দেয়ার দাবি করেন। বলেন, তামান্না ফিরে এসে দুপুরে খাবার খাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে যে এভাবে হারিয়ে যাবে তা তারা ভাবতে পারেননি।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরী, পুলিশ, র?্যাব, ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা উপস্থিত হন। পরে ফ্লাইট সেলভি এন্ড সেগুলেশন পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনামসহ চার সদস্যের প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমির সভাপতি ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দীন আহমেদ (বীরউত্তম) বলেন, প্রশিক্ষণ ফ্লাইটটির ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। গ্রাউন্ডে সিগন্যাল পাঠিয়েই রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরে অবতরণের চেষ্টা চাল?ান প্রশিক্ষণার্থী পাইলট ও প্রশিক্ষক। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। রানওয়েতে নেমে ফ্লাইটটি ছিটকে পড়ে।
নিহত পাইলট তামান্নার বাড়ি রাজধানী ঢাকার নিকুঞ্জ-২ নম্বরে। আহত লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাহেদ কামালের বাড়ি নড়াইল জেলায়।
এদিকে সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার এনামুল কবির বলেন, আমরা সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের ফায়ারসার্ভিসের গাড়ি যাতে পানির পরিবর্তে ফোম (কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি) ব্যবহারে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। তবে এর আগে কো-পাইলটের মৃত্যু হয়েছে। তিনি আরও জানান, রাজশাহীর হজরত শাহ মখদুম বিমানবন্দরে ৬ হাজার ফিট রানওয়ে রয়েছে। সেখানে গ্যালাক্সি, ফ্লাইয়িং ক্লাব ও অ্যাভিয়েশন এই তিনটি প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট দক্ষতার সাথে বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। তিনি ফায়ারসার্ভিসের গাড়ি বিলম্বে যাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তারা যথা সময়েই ঘটনাস্থলে যায়। তবে তাদের কাছে সংকেত যেতে ৩/৪ মিনিট সময় লেগেছে। যা স্বাভাবিক।