নির্বাচনে যাবে বিএনপি চ্যালেঞ্জে আওয়ামী লীগ

SHARE

alig bnpখানিকটা হলেও হোঁচট খেয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে বিএনপির নাটকীয় ইতিবাচক মনোভাব আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখন তাদের নির্বাচনী কৌশলকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করার কৌশলের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করার কৌশল গ্রহণ করেছে। এদিকে গতকাল আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা সিটি নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও একাধিক নেতা বিএনপিকে এ মর্মে সতর্ক করে দিয়েছেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নিয়ে বিএনপি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে।
তারা বলেছেন, অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেই তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত।
আগামী ২৮ এপ্রিল ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও হবে। গত বুধবার এই তিন সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। এর আগে থেকেই অবশ্য সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা বিএনপি ও তার জোটকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছিল আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে বিএনপি আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না দিলেও দলটির নেতারা বিষয়টিতে ইতিবাচক মনোভাবই দেখিয়েছেন। দলের কয়েকজন নেতা বলেছেন, দল ও জোটে আলোচনা করেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন তারা। শুক্রবার রাতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার গুলশান কার্যালয়ে দেখা করে বিএনপিপন্থি পেশাজীবী নেতা অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেছেন, সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের মনোভাব ইতিবাচক বলে তার মনে হয়েছে।
সিটি নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির এমন অবস্থানে নড়েচড়ে বসেছে আওয়ামী লীগও। কিছুটা অপ্রস্তুতও হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। এর আগে থেকে ক্ষমতাসীন মহল থেকে ধরেই নেওয়া হচ্ছিল, ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের মতো সিটি নির্বাচনেও যাবে না বিএনপি জোট। সে ক্ষেত্রে এই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও উৎসবমুখর করে তুলতে বেশি সংখ্যক প্রার্থী ও দলকে নির্বাচনে
নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চলছিল সরকারি মহল থেকে। বিএনপি জোটের বাইরের দলগুলোকেও বেশি সংখ্যায় নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করার কৌশলও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি হঠাৎই সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে ইতিবাচক মনোভাব দেখানোয় মেয়র, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলর পদের প্রার্থী বাছাইয়ের বেলায় আরও সতর্কতা অবলম্বনের কৌশল নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে চুলচেরা বিশ্লেষণের পর শক্তিশালী ও জয়লাভের সম্ভাবনা বেশি রয়েছে এমন প্রার্থী বাছাইয়ের ওপরই বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে।
এই কৌশলের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যেই গণভবনে বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে দলসমর্থিত প্রার্থী হিসেবে অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রার্থীকে বেছে নিয়েছেন। উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকায় আগে যে দুইজন মেয়র প্রার্থীকে দল থেকে সমর্থন দেওয়া হয়েছিল, তাদের একজনের বিষয়ে ঋণখেলাপির অভিযোগ ওঠায় এ বিষয়েও নতুন করে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে। পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের সর্বাত্মক নির্বাচনী তৎপরতায় ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ঢাকার দুই সিটির নির্বাচন পরিচালনায় আলাদা আলাদা কমিটিও করে দিয়েছেন তিনি। রাজধানীর ১৫টি সংসদীয় আসনকে ঘিরে করা হচ্ছে আরও ১৫টি সমন্বয় কমিটিও। চট্টগ্রামের নির্বাচন পরিচালনায়ও অনুরূপ কমিটি গঠনের পরিকল্পনাও রয়েছে। সব মিলিয়ে সিটি নির্বাচনকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সর্বাত্মক নির্বাচনী তৎপরতায়ই নেমেছে ক্ষমতাসীন দল।
এদিকে ক্ষমতাসীন দল ও জোট নেতারা গতকাল বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সিটি নির্বাচন প্রশ্নে আরও বলেছেন, বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নিলেও তাদের বিরুদ্ধে হরতাল-অবরোধের নামে নাশকতা-সন্ত্রাস ও মানুষ হত্যার মামলাগুলো চলবে। মানুষ হত্যার দায় থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও রেহাই পাবেন না।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু গতকাল বরিশাল সরকারি বিএম কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, সরকার চায় বিএনপি জোট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে অগণতান্ত্রিক ধারা থেকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসুক। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে সব দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে আসা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে গত আড়াই মাস ধরে টানা অবরোধের পাশাপাশি হরতালও করছে। অবরোধ-হরতালে সারাদেশে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ, অগি্নসংযোগ ও ককটেল হামলায় শতাধিক মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। এর সমালোচনা করে আমির হোসেন আমু বলেন, তাদের আন্দোলন কোনো দলের বিরুদ্ধে কিংবা কোনো সরকারের বিরুদ্ধে নয়, দেশ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। নাশকতায় জড়িতদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সমকালকে বলেন, নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ফোন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাবের পরও নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আসেনি বিএনপি। অথচ এর পর তারা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তখন আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল। এখনও সরকারে আছে আওয়ামী লীগ। এবার তারা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে তাদের জবাব দিতে হবে, কেন তারা কথিত আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে অসংখ্য মানুষ খুন করল? কেন এখনও আগুনে পোড়া মানুষের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আছে? কেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা হলো? কেন শিক্ষার্থীদের আতঙ্কে রাখা হলো? আসলে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার বেলায় বিএনপি খুবই দক্ষ। মুনাফেকি আচরণ করাটা তাদের মজ্জাগত অভ্যাস।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে স্বাধীনতা ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, সিটি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর দেশে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। গণতন্ত্রের প্রধান উপাদান নির্বাচন। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের এ নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত।
খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনগণকে স্বাধীন মতামত প্রদানের সুযোগ দিন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জনগণকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়াটাই গণতন্ত্রে বিশ্বাসীদের দায়িত্ব।
জাসদের সভাপতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু কুষ্টিয়ার মিরপুরের নওদা বহলবাড়িয়া আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় স্বাগত জানাচ্ছি। তবে আন্দোলনের নামে খালেদা জিয়া একাত্তরের গণহত্যার মতো পরিকল্পিত হত্যাকা চালাচ্ছেন। তাই নির্বাচন বর্জন করুক অথবা অংশগ্রহণ করুক, আগুন-সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে পরিকল্পিত হত্যাকা ের মামলা থেকে খালেদা জিয়াকে রেহাই দেওয়া হবে না।
খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি আরও বলেন, ‘গাছেরটা খাবেন, আবার তলারটাও কুড়াবেন? বাংলাদেশেও থাকবেন, আবার রাজাকারিও চালাবেন? এ রকম দ্বিমুখী নীতি বাংলাদেশে আর চলবে না।’
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি বিএনপির অংশগ্রহণকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। সমকালকে তিনি বলেছেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের বিষয়টিকে স্বাগত জানাচ্ছি। বিএনপি সন্ত্রাসী কার্যক্রম ছেড়ে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে আসুক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তারা জঙ্গিবাদ ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করুক, এটা জাতির আকাঙ্ক্ষা।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ অবশ্য বলেছেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হিসেবে সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। কেবল কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করা যায়। সে হিসেবে আওয়ামী লীগও এ নির্বাচনে কাউকে কাউকে সমর্থন দেবে। বিএনপি যদি প্রার্থীদের সমর্থন দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে চায়, সেটি তাদের বিষয়। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ কিছু ভাবছে না। তবে আওয়ামী লীগ চায়, সবার অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন হবে। যেখানে জনগণও অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাদের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবে।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল রাজধানীর গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ক্রীড়া অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, তিন সিটির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেউ যেন জনগণের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে না পারে, সেদিকে কড়া নজর রাখবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নিয়ে বিএনপি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
তিনি বলেন, বিএনপি সিটি নির্বাচনে এলেই যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে, এমন আশঙ্কা করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ এ মুহূর্তে নেই। এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। জাতীয় নেতাদের কোনো উপস্থিতি এখানে থাকবে না। নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী দলীয় কোনো স্লোগান, এমনকি ছবিও এখানে থাকবে না। নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা কখন কী করতে পারবেন আর পারবেন না, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের আইনেই বলা আছে।
এদিকে, চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ মানবকণ্ঠ আয়োজিত ‘আমাদের রাজনীতি, আমাদের অর্থনীতি’ গোলটেবিল আলোচনায় হরতাল-অবরোধ ছেড়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আসার জন্য খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়া জাতীয় নির্বাচনে এলেন না; কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের পরই যে উপজেলা নির্বাচন হলো, সেখানে আসতেও ভুল করলেন না। তিনি অবরোধ দিচ্ছেন, হরতালও দিয়েছেন। আবার শোনা যাচ্ছে তিনি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আসবেন। অবশ্যই তিনি আসবেন। কিন্তু অবরোধ ও হরতাল চলবে, আবার নির্বাচনও চলবে_ এভাবে দুই স্ট্যান্ডার্ড তো চলতে পারে না। যদি নির্বাচনে আসেন, তাহলে অবশ্যই অবরোধ-হরতাল পরিহার করে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের নিয়ে নির্বাচনে আসুন।