ছেলেকে দেখতে কী নিয়ে এসেছেন? প্রায় এক মাস পরে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে আসা মা তখন ব্যাগ থেকে বাটি বের করে খাবার দেখালেন।
বাড়িতে হয়তো এর চেয়ে বেশি তেমন কিছুই ছিল না। দুইটা রুটি, একটা ডিম; সঙ্গে পলিথিনে করে মুড়ি। তাই নিয়ে এসেছেন কলিজার ধনকে দেখতে। মায়ের মন তো! আধ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছেন। একটু পরে কয়েকজন কিশোরকে নিয়ে আসা হলো। কার ছেলে কোনটা? খোঁজার তাড়াহুড়ো শুরু হলো। সন্তানকে দেখেই মায়ের বুক যে ফেটে যাচ্ছে, তা বুঝতে চোখের গড়িয়ে পড়া পানিই যথেষ্ট। দেখা হওয়ামাত্রই ছেলেকে পাশে বসিয়ে খাবার বের করে খাওয়াতে শুরু করলেন নিজ হাতে। যতটা আদর করে খাওয়ানো যায়। এতদিন পর মায়ের হাতের খাবার আর আদর পেয়ে ছেলেরও চোখের পানি বাধা মানল না। এক হাতে পানি মুছতে মুছতে খাওয়া শুরু করল। গাজীপুর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে (শিশু-কিশোরদের কারাগার) সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার দেখা করতে আসার দৃশ্যটা ছিল এমনই আবেগঘন।
ছেলের সঙ্গে থাকার জন্য হাতে মাত্র ২০ মিনিট সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে কী খাওয়াবেন, আর কী বা খোঁজ নেবেন? মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সময় শেষ। এমন একজন বাবা ইসমাইল হোসেন। দুই সপ্তাহ পর মাদ্রাসাছাত্র ইমরান হোসেনকে দেখতে এসেছেন কেন্দ্রে। নিজেও জানেন, সকাল ১০টার আগে সাক্ষাতের দরজা খুলবে না। তবুও প্রায় পৌনে দুই
ঘণ্টা আগে এসে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের দরজার সামনে বসে অপেক্ষা করছেন। তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে এসেছেন। ছেলের জন্য স্বামীর হাতে কিছু ফলমূল দিয়েছেন ইমরানের মা। বারবার ফোন করে স্বামীর কাছে জানতে চাইছেন ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে কিনা। অপেক্ষার পর ছেলের সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্রই মোবাইল ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলেন তিনি। ‘আমি ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছ? আমি ভালো আছি, আমার কোনো সমস্যা নেই, তুমি কাইন্দো না মা।’ কথাগুলো বলতে বলতে নিজেও চোখ মুছল ইমরান। পাশে বসে বাবা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ছেলেকে বললেন, ‘খাওয়া শেষ করো বাবা’। তোমার সময় শেষ হচ্ছে। একটু পর বাবা-ই ছেলেকে নিতে আসা নিরাপত্তা প্রহরীর কাছে দুই মিনিট সময় চেয়ে নিলেন ছেলের খাবার শেষ করার জন্য। সাক্ষাৎ শেষে একে একে সবাইকে তল্লাশি করা হবে। বাইরে থেকে কিশোরদের কিছু ভেতরে নেওয়ার অনুমতি নেই। তল্লাশি শেষ। আবাসিক হোস্টেলে ফিরছে তারা। পেছন থেকে মা আঁচলের আড়ালে চোখ মুছে বিদায় দিয়ে বাড়ি ফেরেন মনিকগঞ্জ থেকে আসা সবুজের মা।
নিজেদের থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে চার মাস আগে আসা এক কিশোর বলে, আমাদের থাকা-খাওয়ার খুব বেশি সমস্যা হয় না। শুধু আব্বা-আম্মার জন্য মন খারাপ হয়। আমার ঘরের সঙ্গীর সঙ্গে আমার খুব মিল হয়েছে। আমরা গল্প করেই সময় কাটাই।
কিছু অভিযোগ :গাজীপুর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের আসন সংখ্যা ২০০। বর্তমানে (গত ৮ মার্চের তথ্যানুযায়ী) ৩৫৪ জন কিশোর আছে। কিশোরদের পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সুযোগ আছে। যারা পড়াশোনা করে না তাদের জন্য বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে স্কুলপড়ূয়া কিশোরের সংখ্যা ১৫১ এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীর সংখ্যা ৮০।
কেন্দ্রে থাকা কয়েকজন কিশোর জানায়, অপেক্ষাকৃত জ্যেষ্ঠদের দাপট বেশি। তারা কনিষ্ঠদের দিয়ে কাপড় কাচা থেকে শুরু করে জোর করে যাবতীয় ব্যক্তিগত কাজ করায়। না করলে মারারও হুমকি দেয় বলে জানায় তারা। নির্ধারিত সরকারি ডাক্তার না থাকায় অসুস্থ হওয়া কিশোরদের চিকিৎসার অসুবিধা রয়েই গেছে। পুলিশ কর্তৃক আটক এবং অভিভাবকদের আবেদনের মাধ্যমে আসা কিশোরদের আলাদা আবাসন ব্যবস্থা নেই। ফলে অপরাধ করে আসা কিশোরদের সঙ্গে স্বাভাবিক কিশোরদের বিবাদ লেগেই থাকে। কেন্দ্রে দৈনিক পত্রিকাও সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। কেন্দ্রে আগত কিশোরদের পঞ্চম শ্রেণীর পর সাধারণ শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া পর্যাপ্ত কিশোর আদালত না থাকায় মামলা নিষ্পত্তি নিয়েও জটিলতা তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা।
অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিচালক জুলফিকার হায়দার সমকালকে বলেন, কেন্দ্রে কিছু সমস্যা এখনও আছে। সমাধান হতে সময় লাগবে। কেন্দ্রের নিবাসীদের তদারকি করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, জনবল, মেডিকেল শাখাসহ আরও বেশকিছু বিষয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষও আশ্বাস দিয়েছে।