মাঠ অভিমুখী অকল্যান্ড-হ্যামিল্টন মোটরওয়েতে একটা ফোনে কথা বলতে গিয়ে আপাত আজব টিপ অফটা পাওয়া গেল! বাংলাদেশ নাকি আজ নিউজিল্যান্ডের কাছে হারলে এতটুকু দুঃখিত হবে না। কারণ তারা সেটাই চায়।
একমাত্র তা হলেই যে মেলবোর্নে ভারতের সামনে পড়বে।
আর সবচেয়ে বড় কারণ নাকি তিনি সম্পূর্ণ ফিট অবস্থায় ভারতের সঙ্গে এমসিজির কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে চান। ম্যাচ জিতলে বাংলাদেশ পড়বে দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে। কিন্তু তারা নাকি সেটা চায় না। এই বিশ্বকাপের যুগ্ম সেরা দল ভারত। লোকে তাদের থেকে পালাতে চাইবে এটাই স্বতঃসিদ্ধ। অথচ টিম বাংলাদেশ তাদেরই চায় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে।
এই সব জল্পনার অনেক ঊর্ধ্বে থাকা বাংলাদেশি জনতা ততক্ষণে কন্ট্রোল নিয়ে নিয়েছে। স্থানীয় বিয়ার কোম্পানি মাঠে ঢোকার সময় কমলা রঙের পোশাক এগিয়ে দিচ্ছিল স্পেশ্যাল অফার সমেত। অফারটা হলো, ওই কমলা ড্রেস পরে যদি গ্যালারিতে উড়ে আসা কোনও ছক্কা আপনি লুফতে পারেন, তা হলে হাজার ডলার জিতবেন। লোভনীয় অফার। স্যর রিচার্ড হ্যাডলি যে দিকটায় বসে খেলা দেখছিলেন, সেই স্পনসরস্ বক্সের ডান দিকটা তো পুরো কমলায় কমলা! কিন্তু অকল্যান্ড থেকে এসি বাস বোঝাই করে, হাইওয়ে ভর্তি লাইন দেওয়া গাড়িতে যে গর্বিত বাংলাদেশিরা এসেছেন তারা কোন দুঃখে দেশের লাল-সবুজ রঙ ছেড়ে কমলা পরবেন?
কিছু লাল-সবুজ শাড়িও দেখলাম। মহিলারা সঙ্গে সবুজ রঙ নিয়ে এসেছেন। সেগুলো সমর্থকেরা নিজেরাই ভাগাভাগি করে মেখে নিচ্ছেন। ভারতে যেমন পেশাদার রং-করিয়েরা স্টেডিয়ামের বাইরে বসে থাকে এখানে সে সব নেই। কিন্তু তাতে কিছু আটকাচ্ছে না। ডিজে দ্রুত শুরু করে দিলেন। কখনও অরিজিৎ সিংহ। কখনও বাংলাদেশের বিখ্যাত পপ গায়িকা মমতাজের আইটেম নম্বর। কখনও অকৃত্রিম সাধের লাউ।
মেঘলা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ আর নতুন পিচে ব্রেন্ডন ম্যাকালাম ব্যাট করতে পাঠিয়েছেন। বল তো শুধু সুইং নয়, মনে হচ্ছে সিমও করবে। এই রকমই পিচে তো শচিন-শেবাগ সমেত সৌরভের সময়কার এত জাঁদরেল টিম ইন্ডিয়া দু’ইনিংসে আছড়ে পড়েছিল ৯৯ আর ১৫৪। প্রথম দশ ওভারে টুর্নামেন্টের সেরা পেস বোলিং কম্বিনেশন টিম সাউদি আর ট্রেন্ট বোল্ট যখন দুটো উইকেট পড়াকে আরও স্বাগত জানাতে স্লিপ সংখ্যা তিন থেকে চার করে নিলেন, তখন মনে হচ্ছিল ডিজে-র খুব বেশি গান স্টক করতে হবে না!
সেই ম্যাচ কি না থরথর উত্তেজনার মধ্যে গিয়ে শেষ হলো একেবারে শেষে। সাত বল বাকি থাকতে তিন উইকেটে জিতে গেল নিউজিল্যান্ড। ম্যাচে যে পরিমাণ নাটকের আমদানি ছিল তাতে নিউজিল্যান্ড আচমকা হেরে গিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালের গতিপথ বদলে যেতে পারত। ম্যাচের শেষ দশ মিনিটেও টুইটারে তীব্র জল্পনা চলেছে, সাংবাদিকবন্ধু এবং ভারতীয় ফ্যানেরা এখুনি টিকিটটা করে ফেলো না। অকল্যান্ডে টিভির সামনে বসে থাকা ভারতীয় ক্রিকেট দলও তখন উত্কণ্ঠিত। অদ্ভুত পরিস্থিতি- বাংলাদেশ হারলে তারা মেলবোর্ন যাবে। জিতলে এসসিজিতে শ্রীলঙ্কার সামনে পড়বে।
নিউজিল্যান্ডের টুর্নামেন্টে অপরাজিত থাকার গরিমা প্রায় কেড়েই নিয়েছিল বাংলাদেশ। মাহমুদুল্লাহ টানা দু’টো সেঞ্চুরি শুধু করে ফেললেন না, টুর্নামেন্টের সেরা পাঁচ রানকারীর মধ্যে শিখর ধবনকে এদিন টপকে গেলেন। ময়মনসিংহের ছেলে। যে শহরের ধানের কথা কবিতায় পাওয়া যায়। আর শুঁটকি মাছের গৌরবকাহিনি ভোজনরসিকদের নিত্য আলোচনায়। কিন্তু ময়মনসিংহ শহরের আপাতত তিনিই সেরা রফতানি। ডাকনাম রিয়াদ। এ দিনও বাংলাদেশি সাংবাদিকদের গরিষ্ঠ অংশ হ্যামিল্টন প্রেসবক্সে বসে বলছিলেন, রিয়াদ এমন সব কাণ্ড ঘটাচ্ছেন তাদের চিমটি কেটে দেখার মতো! সত্যিই তো? মুশফিকুর রহমানের তিনি ভায়রাভাই বলে নির্বাচিত হয়েও তাকে নিয়মিত কথা শুনতে হয়েছে। স্বজনপোষণের সুযোগ পাওয়াই নাকি তার একমাত্র যোগ্যতা। সমালোচনা-সমালোচনায় আক্রান্ত তিনি মাঝে বছরখানেক টিম থেকে বাদ ছিলেন। গত ডিসেম্বরে আবার ফিরেছেন। টিমে একমাত্র হিন্দু ক্রিকেটার সৌম্য সরকার এবং রিয়াদের পার্টনারশিপ এই ধারণার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় মাস্তুল যে না, বাংলাদেশ ইচ্ছাকৃত ম্যাচ ছাড়েনি। আপ্রাণ লড়েও পারেনি।
চার উইকেট নিয়েও সাকিব-আল-হাসান অবিসংবাদী ভাবে তালিকায় নেই। খেলার শেষে এ দিনের অধিনায়ক সাকিবের কতগুলো বিহ্বল করা সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমুল জল্পনা চলছিল। ক্রিকেটীয় ভুল? না ইচ্ছাকৃত? যেমন নিজে এত ভালো বল করেও কোটার চেয়ে এক ওভার কম করা। মার্টিন গুপ্টিল এবং রস টেলর- ম্যাচ নিয়ে যাওয়ার পার্টনারশিপ যখন করে ফেলেছে নিউজিল্যান্ড, তিনি দ্বিতীয় স্পেলে দু’ওভারের জন্য আসবেন না? রুবেল হোসেন আগের ম্যাচে ইংল্যান্ডকে চমকে দিয়ে বিশ্ব দরবারে ঢুকে পড়েছেন। তাকেও তো দু’ওভার কম বল করালেন সাকিব। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করলেন আট জনকে। টিমে আট জন ব্যাটসম্যান ছিল। আট জন বোলার কোথা থেকে এলো?
তিনটা কারণ হতে পরে।
দুই, টিমের দীর্ঘকালীন স্বার্থের কথা ভেবে সমস্ত অঙ্গ মেপে নেওয়া। তাতে স্বল্পকালীন ক্ষতি হতে পারে জেনেও।
তিন, এবং হয়তো নিছক গুজবের তিন, বাংলাদেশ সত্যিই মনপ্রাণ দিয়ে ম্যাচটা জিততে চায়নি।
অর্থাৎ বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভাষায় পাতানো খেললাম না। ওটা ঘৃণ্য কাজ। আবার জেতার জন্য মরণবাঁচনও গেলাম না। আমাদের জন্য কোয়ার্টার ফাইনাল সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট। সেটায় জেতার জন্য যা যা করলে ভাল, সেই ট্যাকটিক্যাল লগ্নিটা করে রেখে দিলাম।
ম্যাচ শেষে সেডন পার্ক ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে আসা বাংলাদেশ ম্যানেজার সুজন অবশ্য বলে গেলেন, “বাংলাদেশ হারতে চেয়েছিল এটা আজগুবি। এটা ঠিক সাকিবের কিছু সিদ্ধান্ত আশ্চর্যজনক। কিন্তু ক্রিকেটে ক্যাপ্টেন কি এমন ভুল করে না?” সুজন মনে করেন, তাদের জন্য ভারতীয় বিস্ফোরক ব্যাটিং লাইন-আপ আর এমসিজি ভর্তি ভারত সমর্থক অনেক বেশি কঠিন হবে দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে। শখ করে কোন টিম চাইবে তার সামনে পড়তে?
তিনি অস্বীকারের পরেও গুঞ্জনটা কিন্তু থেকেই গেল। দক্ষিণ আফ্রিকা মানে নক আউটে আরও ভয়ঙ্কর হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেখানো মর্কেল-স্টেইন। সেটার মোকাবিলা করা নাকি বাংলাদেশিরা বড় ঝুঁকি মনে করছেন। তুলনায় ভারতের তেমন হাড়হিম করে দেওয়া বোলার নেই। তা ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ওয়ান ডে-তে ভারতকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বাসটা আছে, আবার পারবে। যতই মিরপুরের মাঠে আগের বিশ্বকাপ উদ্বোধনীতে শেবাগের ১৭৫ একাই তাদের উড়িয়ে দিক!
আরও একটা অদ্ভুত কথা শোনা গেল। ছেলেরা নাকি বলেছে, উল্টো দিকে ভারত প্রতিদ্বন্দ্বী হলে তাদের চার্জড হতে খুব সুবিধা হয়! শুনতে শুনতে মনে হলো, ফরাক্কার জল কি তা হলে এত দূরমহাদেশেও পৌঁছে গেল?
গৌতম ভট্টাচার্য: ভারতীয় সাংবাদিক