দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা আন্দোলনে বিএনপি। যাতে জোটের অন্যতম শরিক জামায়াত ছাড়া অন্য দলের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। অতীতের মতো তৃণমূল নেতাকর্মীরা মাঠে থাকলেও লোকচক্ষুর আড়ালে শীর্ষ নেতারা। অনেকে বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। কেউ আবার জটিল জটিল রোগে ভূগছেন। তবে যেসব নেতা শারীরিকভাবে শক্ত আছেন তারা আবার গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে আছেন।
আবার অভিযোগ আছে, শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগই সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে চলছেন। যার কারণে তারা গ্রেফতার তো দুরের কথা কোনো ধরণের হয়রানির শিকারও হচ্ছেন না। অথচ সারাদেশে তৃণমূলের ছোটখাটো নেতারা ঘরে থাকতে পারছেন না, বেরাচ্ছেন পালিয়ে।
আর আন্দোলন শুরুর দিকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কারাগারে আছেন সাবেক ছাত্রনেতা ও যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তার আটকের কয়েকদিন পর রাজধানী থেকে আটক হন সাবেক ছাত্রনেতা শামসুজ্জামান দুদু। দুজনেই কারাগারে আছেন।
জানা যায়, খালেদা জিয়া আন্দোলনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভরসা রাখেন ছাত্রদল ও যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীদের ওপর। এছাড়া সাবেক ছাত্রনেতাদের প্রতি তার আস্থা রয়েছে। সে জন্য আন্দোলনের আগে এসব নেতাদের ঝালাই করতে জাতীয় কনভেশনের ডাক দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। গতবছরের ১৮ ডিসেম্বর ৯০’র ছাত্রঐক্যের কনভেনশনে যোগ দিয়ে সাবেক ছাত্রনেতাদের উদ্দেশে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেছিলেন, “শুধু স্লোগান নয়, ভেদাভেদ ভুলে সবাই প্রস্তুতি নাও। যেকোনো সময় ডাক দেয়া হবে। এবার শুধু ঢাকাকে দোষ দিলে হবে না, সবাইকে মাঠে নামতে হবে।”
ওইসময় অনুষ্ঠানের সভাপতি ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমানসহ ছাত্রনেতারা মাঠে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত আছি।” জানুয়ারিতে আন্দোলন শুরুর পর আমান উল্লাহ আমানকে আর রাজপথে দেখা যায়নি। কনভেনশনে বক্তব্য দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছেন। আরো যারা ছিলেন তারাও মাঠে নেই। চলে গেছেন নিরালায়।
সারাদেশে প্রশাসনের চরম কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। তারপরেও মাঠে থাকার চেষ্টায় কমতি নেই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। অথচ আন্দোলনের নিউক্লিয়াস খ্যাত সাবেক ছাত্রনেতারা মাঠে নেই। আছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফুরফুরে সময় কাটাচ্ছেন বলেও গুঞ্জন আছে।
এদের অনেকে খুব পরিচিত ছাড়া কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না। পুরনো সিম বাদ দিয়ে নতুন সিম দিয়ে কথা বলছেন ঘনিষ্টজনদের সাথে। এদের খোঁজ দিতেও নিষেধ রয়েছে ঘনিষ্ঠজনদের। যার ফলে কে কোথায় আছেন তা জানা দুষ্কর হয়েছে।
গত ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় বিএনপির নেতৃত্বে দেশব্যাপী শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের অবরোধ। যা এখনো চলছে। অথচ ওই মাসের ১৬ তারিখ জাতীয় সংসদের এলডি হলে ধুমধাম করে ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান করেন আমান উল্লাহ আমান। বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকলেও এরপর থেকে তাকে আর দেখা যায়নি। চলে গেছেন গোপনে।
সোমবার বিকেলে আমানের ঘনিষ্ঠ একজন বলেন, “ভাই কোথায় আছেন তা আপনারা ভালোই জানেন। এতোগুলো মামলার আসামি হলে রাস্তায় নামা যায়?”
নাজিম উদ্দিন আলম কোথায় আছেন জানা নেই কারো।গত সপ্তাহে তার ঘনিষ্ট একজনের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, “আলম ভাই ঢাকায় আছেন।এটুকু বলতে পারি।”
এদিকে আগে হুঙ্কার দিলেও বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারাও হাঁটছেন সাবেক ছাত্রনেতাদের পথে। শুরুর দিকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই একটি ঝটিকা মিছিলে অংশ নিলেও এখন আর তাদের দেখা যায়না। এছাড়া যুবদলের সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কারাগারে। মুক্ত থাকলেও দেখা নেই সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরবের।
নীরবের ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, তিনি (নীরব) সরকারের হিটলিস্টে আছেন। তাই আড়ালে থেকেই যুবদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে দাবি তাদের। কিন্তু কর্মীদের অভিযোগ আত্মগোপনে থাকছেন নীরব।
স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল। একইসঙ্গে যিনি ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, মির্জা আব্বাস-সোহেলের ঢাকা মহানগর কমিটিও ‘ব্যর্থ’। সারাদেশে নেতাকর্মীরা মাঠে থাকলেও ঢাকার নেই কেউ।এজন্য সরকারের কঠোর অবস্থানকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছেন রাজধানীর নেতারা। সোহেল মাঝে মঝ্যে দুই/একটি মিছিল নিয়ে অলিগলিতে বের হলেও কোথাও নেই মির্জা আব্বাস। তাকে পাওয়া যায় শুধুমাত্র বিবৃতিতেই।
এদিকে আন্দোলন শুরুর আগ থেকে নিজ কার্যালয়ে অবস্থান করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে সেখানে যেতে পারছেন না দলের দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। আবার ট্র্যাকিংয়ের ভয়ে তারা মোবাইলেও কথা বলছেন না। এসব কারণে আন্দোলন নিয়ে নতুন করে ভাবতে বিএনপিকে বেগ পেতে হচ্ছে বলে দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে।
স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের একজন মারা গেছেন। চারজন অসুস্থ। তবে এদের মধ্যে তরিকুল ইসলাম যশোরে বসে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। তিনজন কারাগারে। একজন কূটনৈতিক পাড়ায় যোগাযোগ রাখছেন। আর আন্দোলন শুরু হলে একজনের বিরুদ্ধে হাসপাতালে ভর্তি হন বলে অভিযোগ থাকলেও কিছুদিন ধরে তিনি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আছেন। বাকিরা চুপচাপ।
আর আরেক সদস্য ও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস রয়েছেন শুরু থেকেই লোকচক্ষুর আড়ালে।
১৮জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে একজন মৃত ও একজন বহিষ্কৃত। বাকিদের মধ্যে সেলিমা রহমান রয়েছেন গুলশান কার্যালয়ে। আর মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ দেশে বসে আর সাদেক হোসেন খোকা বিদেশে বসে মাঝে মাঝে বার্তা দিচ্ছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৩৬ জন। এদের মধ্যে একজন মৃত্যু বরণ করেছেন। দু জন কারাগারে আছেন। দু্ই একজনকে টেলিভিশন টকশোতে দেখা যায়। বাকিরা মাঠে নেই। কোথায় আছেন তাও জানেন না নেতাকর্মীরা।
সাত জন যুগ্ম-মহাসচিবের মধ্যে দুইজন কারাগারে। মাহবুব উদ্দিন খোকন খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে আদালতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সেখানে হরতাল-অবরোধের পক্ষে আদালত চত্বরে মিছিল সমাবেশ করতে দেখা যায় তাকে।
আর দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য সংখ্যা ৩৮৬। এর মধ্যে ১২১ জন কর্মকর্তা। আর ২৬৫ জন সদস্যের বেশির ভাগই নিষ্ক্রিয়। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া বড় একটি অংশকে দলের কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায় না। আন্দোলনে না থাকলেও পদ পেতে লবিংয়ে সবার আগে।
এসব বিষয়ে কথা বললে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে: জেনারেল (অব:) মাহবুবুর রহমান বলেন, “জেল-জুলুম উপেক্ষা করে নেতাকর্মীরা মাঠে আছেন। অনেকে কৌশল হিসেবে জনসম্মুখে আসছেন না। তবে তারা আন্দোলনে সম্পৃক্ত আছেন।তারা সবাই নিজ নিজ স্থান থেকে কাজ করছেন।”
আন্দোলনে মাঠে না থাকা নেতাদের বিষয়ে দল কোনো ব্যবস্থা নিবে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে দলের চেয়ারপারসন সিদ্ধান্ত নেবেন।”