অবসায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডসহ তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও অনিয়ম খতিয়ে দেখতে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং (কারণ উদঘাটন) কমিটি পুনর্গঠন করেছে হাইকোর্ট। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গেকেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা জড়িত থাকলে সে বিষয়টি খতিয়ে দেখবে কমিটি।
বাকি দুই আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো- বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্সকোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড।
আইনজীবীরা জানান,হাইকোর্টের আগের নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষথেকে পাঁচ সদস্যের কমিটির তালিকা দেওয়া হয়। কমিটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানকে প্রধান ও উপমহাব্যবস্থাপক সারোয়ার হোসেনকে সদস্য সচিব করা হয়।
মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের হাইকোর্টবেঞ্চ আরও দুজনকে কমিটিতে রাখতে আদেশ দেয়। তারা হলেন-সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মহিদুল ইসলাম এবং সাবেক সচিব নুরুর রহমান। অনিয়ম-দুর্নীতি খতিয়ে দেখাসহ ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধে এ কমিটি সুপারিশ ও পরামর্শ দেবে। কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
আদালত আরও বলেছে, এ তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের সঙ্গে কমিটির কোনো সদস্য জড়িত থাকলে বা সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে সেই সদস্য দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকবেন।
এদিকে পিপলস লিজিংয়ের ৫৩ ঋণখেলাপি হাইকোর্টে হাজিরা দিয়েছেন। বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের একক হাইকোর্টবেঞ্চে তারা হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দেন। কানাডায় পালিয়ে থাকা পি কে হালদার সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং থেকে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন এমন ২৮০ ঋণগ্রহীতাকে গত ২১ জানুয়ারি এক আদেশে ২৩ ফেব্রুয়ারি (গতকাল) তলব করে হাইকোর্ট।
আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম ধাপে ১৪০ খেলাপির হাজির হওয়ার কথা থাকলেও হাজির হন ৫৩ জন। বুধবার আরও ১৩৭ জনের হাজির হওয়ার কথা রয়েছে।
আদালত মৌখিক আদেশে বলে, যারা আসেননি (১৪০ জনের মধ্যে) তাদের আরও একবার সুযোগ দেওয়া হলো। যদি ওইদিন না আসেন তাহলে তাদের গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়া হবে।
পিপলস লিজিংয়ের সাময়িক অবসায়ক (প্রবেশনাল লিক্যুডেটর) মো. আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে আদালতে ছিলেন আইনজীবী মেজবাহুর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ। ঋণখেলাপিদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মুশতাক আহমেদ।
ব্যারিস্টার মেজবাহুর রহমান বলেন, ৫৩ জনের মধ্যে চারজন হলফনামা আকারে বক্তব্য জমা দিয়েছেন। বাকিদের বক্তব্য হলফনামা আকারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
আইনজীবীরা জানান, ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওইদিন আদালত আবেদনটি গ্রহণ করে সাময়িক অবসায়ককে তলব করে। পরে বিভিন্ন সময়ে এ সংক্রান্তবেশ কয়েকটি আদেশ হয় হাইকোর্টথেকে। গত বছর নভেম্বরে আদালত অবসায়ককে পিপলস লিজিংয়ের ঋণগ্রহীতাদের একটি তালিকা দাখিলের নির্দেশ দেয়। গত ২৩ নভেম্বর আদালতে তালিকা উপস্থাপন করা হয়। পরে হাইকোর্ট প্রায় ৫০০ জন ঋণগ্রহীতার মধ্যেথেকে যাদের ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ টাকা এবং এর বেশি তাদের একটি তালিকা তৈরি করে। এর মধ্যে ঋণখেলাপি হিসেবে ২৮০ জনের নাম আসে।
অন্যদিকে ব্যাংকিং এবং বিভিন্ন আর্থিকপ্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যানের বক্তব্যশুনবে হাইকোর্ট। আগামীকাল তিনজনকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হতে বলা হয়েছে।
শুনানিকালে পিপলস লিজিংয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে পি কে হালদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক ডেপুটি গভর্নরের নাম আসে। এ সময় উষ্মাপ্রকাশ করে শাহ আলমকে ‘চোর’ ও ‘ডাকাত’ বলে আখ্যায়িত করে হাইকোর্ট।
আইনজীবীদের উদ্দেশে হাইকোর্ট বলে, পি কে হালদার কী আকাম-কুকাম করেছে, সেটা আমরা দেখেছি। প্রতিষ্ঠানটিতে (পিপলস লিজিং) যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা সেখান থেকে মধু খেয়েছেন। এখন এ কোম্পানিকে বাঁচিয়ে রেখে টাকা উদ্ধারকরা যায় কি না, সেই চেষ্টা করতে হবে।
আদালত আরও বলে, আমানতকারীরা খেয়ে, না খেয়ে রাস্তায় ঘুরছেন। আমরা ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করছি। একটি কোম্পানি অবসায়ন করতে হলে এর একটা প্রক্রিয়া থাকবে। আমরা সেটা যেমন দেখছি, তেমনি টাকাগুলো উদ্ধারের একটা পথ বের করার চেষ্টা করছি।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, অর্থলোপাটের তথ্য চাপা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায়িত্ব থেকে গত ৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে একটি বিভাগের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে এখনো দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার আগে পি কে হালদারের নিয়ন্ত্রণাধীন চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একটি পিপলস লিজিং। আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটিকে ১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৫ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে লোকসান গুনতে থাকে সংস্থাটি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির আমানত দেখানো হয় ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। আর ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৪৮ কোটি টাকা খেলাপি।