ক্রিকেট দিয়েই জীবনে ফিরতে চাইছে আফগানিস্তান

SHARE

ভারতে বেশ কয়েক বছর পড়াশোনা করার সুবাদে ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে বেশ ভালোই। হায়দরাবাদে মাঝেমাঝেই বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেটে মেতে উঠতাম। আমার দেশে ক্রিকেট কার্যত সদ্যজাত শিশু। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে ক্রিকেটের জন্ম। প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান থেকেই আমাদের দেশে ক্রিকেটের আবির্ভাব। আর কয়েক বাকি বিশ্বকাপের। ভাবলে রোমাঞ্চ হচ্ছে বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ মঞ্চে বাকি তাবড় তাবড় দেশগুলির সঙ্গে লড়তে নামছে আমার দেশও। শক্তির নিরিখে আমরা ক্ষুদ্র হতে পারি। কিন্তু ক্রিকেটের লড়াইয়ে যে কাউকে বিনা যুদ্ধে মাটি ছাড়বো না আমরা, সেকথা বলতে পারি বুকে হাত রেখে।

গত দুই দশকে অনেক রক্তপাত দেখেছি আমরা। এখনও অব্যহত রক্তপাত। রাতের বেলা কান পাতলে নিস্তব্ধতার মাঝেমাঝেই দূরে গোলাগুলির আওয়াজও শোনা যায়। সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। তিন মাস হয়েছে নতুন সরকার হয়েছে। কিন্তু এখনও তৈরি হয়নি মন্ত্রিসভা। সরকারি কাজকর্ম শিকায়। কিন্তু এত রক্তপাত, হানাহানি, সমস্যার মধ্যেও হারিয়ে যায়নি আমাদের স্বপ্ন। সুস্থ, শান্তিপূর্ণ জীবনের স্বপ্ন দেখি আমরা। দেশে নানা সমস্যা। তারমধ্যে ক্রিকেট যেন কিছুটা অক্সিজেন। ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ চ্যাম্পিয়নশিপের মাধ্যমে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছি আমরা। যখন বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম আমরা, তখন গোটা দেশের যারা ক্রিকেট সম্পর্কে খোঁজখবর রাখে, আমাদের মতো তরুণ প্রজন্ম দারুণভাবে উদ্বেল হয়েছিল। বিশ্বকাপে আমাদের গ্রুপে রয়েছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ডের মতো তাবড় তাবড় ক্রিকেট শক্তি। তাদের বিরুদ্ধে আমরা নেহাতই শিশু। কিন্তু ভুললে চলবে না আমরা কিন্তু গত এশিয়া কাপে বাংলাদেশকে হারিয়ে নজর কেড়েছিলাম। গোটা দেশসহ কাবুলে এখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। তাপমাত্রা সবসময়ই থাকছে শূন্যের কাছাকাছি। কিন্তু ক্রিকেট উত্তাপ ছড়াচ্ছে তার মধ্যেই। কাবুলের একটি ইনডোর আকাদেমিতে চলছে জাতীয় দলের প্রস্তুতি। প্রবল ঠাণ্ডায় শুধু নেটে ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিংয়ের অনুশীলনেই শেষ নয় আফগানদের বিশ্বকাপের প্রস্তুতি। শরীর গরম রাখতে ক্রিকেটীয় আভিধানিক অনুশীলনের পাশাপাশি করতে হচ্ছে শাটল রান এবং ভারত্তোলনও। বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য কয়েকদিন আগেই দল গিয়েছিল দুবাইয়ে। সেখানে কয়েকটি প্রস্তুতি ম্যাচও খেলেছে। জাতীয় দলের বেশ কয়েকজন পেশাদার ক্রিকেটার। বাকিরা আংশিক সময়ের জন্য খেলেন। আমাদের দলের বৈশিষ্ট্য হলো, টি-২০ ঘরানার আক্রমণাত্মক ব্যাটিং এবং জোরে বোলিং, যা অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে চমক তৈরি করতেই পারে।

গত বিশ্বকাপের সময় ভারতে ছিলাম। দেখেছি কিভাবে নানা বয়সের অজস্র মানুষ ক্রিকেটের নেশায় বুঁদ হয়ে যান। আমাদের এখানেও কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা নেহাত কম নয়। জালালাবাদের যে গ্রামে আমি থাকি, সেখানে তো বটেই, আফগানিস্তানের শহরে-গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় কিন্তু অনেকেই সময় পেলে ক্রিকেট ব্যাট আর বল হাতে নেমে পড়ছেন। দেশের পূর্ব এবং দক্ষিণাংশেই ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা চোখে পড়ে সবচেয়ে বেশি। আমাদের দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ক্রিকেটার হামিদ হাসান। অধিনায়ক মুহম্মদ নবিও বেশ জনপ্রিয়। গত দু’বছর ধরে দেশের ঘরোয়া লিগ চালু হয়েছে। সিক্সার লিগ। সেখান থেকেও অনেক নতুন ক্রিকেটার উঠে আসছে। বিশ্বকাপে আমরা কেমন খেলবো তা নিয়ে অনেকেরই হয়তো আগ্রহ থাকবে না। কিন্তু একথা বলতে পারি, যুদ্ধদীর্ণ দেশের তিন কোটিরও বেশি মানুষের কাছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট কিন্তু নিছক টিভির সামনে বসে গলা ফাটানোর বিনোদন নয়। নতুন করে জীবনযুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার একটা বাড়তি রসদও। জিতি বা হারি, বড় কথা নয়। দৈনন্দীন জীবনের লড়াইটা জারি থাকবে বাইশ গজেও। আমাদের হারানোর কিছু নেই। কিন্তু ছোঁয়ার জন্য রয়েছে এক আকাশ সমান স্বপ্ন।

(ধ্বংসস্তূপ থেকে ক্রিকেটের মহামঞ্চে। বিশ্বকাপে অভিষেক ঘটতে চলেছে আফগানিস্তানের। আমেরিকান সামরিকবাহিনীর চাপে নাভিশ্বাস উঠতে থাকা যুদ্ধদীর্ণ দেশবাসী ফিনিক্স পাখির মতোই আকাশ ছুঁতে চাইছেন ক্রিকেটকে আঁকড়ে। ক্রিকেট কিভাবে লড়াইয়ের রসদ জোগাচ্ছে আফগানিস্তানবাসীকে, তা নিয়ে কলম ধরলেন জালালাবাদের বাসিন্দা লেখক। পঠনসূত্রে ভারতে ছিলেন বেশ কয়েক বছর। ক্রিকেটকে ঘিরে কিভাবে জীবনের স্বপ্ন দেখছেন আফগানরা, তুলে ধরলেন সেকথা।)