ডিজিটাল টেকনলজি ও ডিজিটাল বাংলাদেশের রমরমা সময়েও বাস্তবে কি ঘটছে সেটা জানা বেশ কঠিন। মাঠের খবর জানতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। অথচ মাঠের খবরের ওপর এখন নির্ভর করছে বাংলাদেশের আগামি রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বাংলাদেশ ছোট দেশ। কঠিন হলেও কি ঘটছে জানতে চাইলে জানা কঠিন নয়। এটা পরিষ্কার যে উত্থানপতন সত্ত্বেও বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি সফল। সেটা একান্তই তৃণমূলের কর্মীদের জন্য। দুই-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া গণমাধ্যম ক্ষমতাসীনদের নির্বিচারে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। ফলে মাঠের ভূমিকা জাতীয় রাজনীতিকে কিভাবে আগামি দিনে প্রভাবিত করতে পারে সেটা সকলের কাছে স্পষ্ট নয়। অধিকাংশ গণমাধ্যম তাদের ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে। সেই ভূমিকা হচ্ছে ফ্যাসিস্ট সরকার-বিরোধী আন্দোলন স্তব্ধ করে দেবার জন্য ক্রমাগত প্রপাগান্ডা চালানো। এতে আসল খবর জেনে বাস্তবোচিত বিশ্লেষণ সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। এমনকি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের জন্যও। সাধারণ মানুষ, যারা সরকারের পে নন কিন্তু সরাসরি আন্দোলন সংগ্রামেও নাই, তারা কিছুটা বিভ্রান্ত বটে। সরকার ক্রমে সব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছে এই প্রপাগান্ডায় অনেকের মনে একটি দ্বিধান্বিত প্রশ্ন আছে যে, এই সরকারের পতন ঘটবে কি? উত্তর : অবশ্যই। সেটা আসন্নই বলা যায়। পতনের প্রশ্ন বিতর্কিত নয়, বিতর্কের জায়গা হোল, পতনের চরিত্র কি রূপ নেবে? সেটা কি একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের, নাকি শুধু হস্তান্তর? এটা এখন জাতীয় নেতানেত্রীদের ওপর পুরাপুরি নির্ভর করবে না। নির্ভর করবে যারা মাঠে আন্দোলন করছেন তারা তাদের সংগ্রামের পরিণতি কিভাবে দেখতে চান তার ওপর। অর্থাৎ নির্ভর করবে তৃণমূলের ওপর।
প্রশ্ন হচ্ছে এখন বাস্তবে- অর্থাৎ অবরোধ কর্মসূচি শুরু হবার পর কি এমন ঘটনা মাঠে ঘটল যাতে ক্ষমতাসীনদের পতন আসন্ন হয়ে উঠতে পারে? কি আলামত দেখছি যাতে আমরা অনুমান করি যে বিদ্যমান পরিস্থিতি বদলে যাতে পারে?
ঘটনা আসলে আগেই ঘটেছে। ক্ষমতাসীনরা দাবি করছিল গণতন্ত্রের কী দরকার? এখন দরকার উন্নয়ন। নির্বাচন একটা হয়েছে পাঁচ বছর পর আবার দেখা যাবে। বিরোধী দল আন্দোলনে হঠাৎ ক্ষান্তি দেওয়ায় এই আওয়ামী থিসিস বল পেয়ে যায়। দ্রুত একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন না করলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়বে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশ যে কথা বলে আসছিল, তা মিথ্যা হয়ে গিয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়া সাত দফা দাবি নিয়ে আন্দোলনে এলেন। তিনি নির্বাচনের কোন নির্দিষ্ট দিন বেঁধে দিলেন না। কার্যত কিছুই প্রায় বললেন না। মাহমুদুর রহমানকে অন্যায় ভাবে বন্দী করে রাখার দাবিসহ তিনি শুধু সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের কথাই বললেন। দেখা গেল শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার প্রস্তাবিত অতি নিরীহ সাত দফা দাবি মেনে একটা সংলাপ বা সমঝোতার কোনো উদ্যোগই নিলেন না। বরং বিএনপিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করবার নীতিতেই অবিচল থাকলেন। খালেদা জিয়া মামলায় হাজির হবার জন্য আদালতে গিয়েছিলেন। সেখানে সশস্ত্র ভাবে লীগ-সমর্থকদের লেলিয়ে দেওয়া হোল। খালেদা ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করবেন বলে একটি সমাবেশ করতে চাইলেন। তাঁর কার্যালয় বালুর ট্রাক ও পুলিশের গাড়ি দিয়ে ঘেরাও রাখা হোল। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের মহিলা সদস্যদের চোখে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনেই কোন প্রকার উসকানি ছাড়া মরিচের গুঁড়া ছুড়ে মারা হোল। পুলিশের নিশ্ছিদ্র বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রেখেও ক্ষমতাসীনরা স্বস্তি পাচ্ছিল না। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের যারপরনাই ভীতি ও অস্থিরতা দেখে বোঝা যায় ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার কোনো নৈতিক শক্তি ক্ষমতাসীনদের আর নাই। খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে তালা লাগাবার মধ্য দিয়েই ক্ষমতাসীনরা তাদের য়ের খবর ঘোষণা করে দিয়েছেন। যারা তালা মেরেছে ক্ষমতা থেকে তাদের পতন ছাড়া তালা খুলবার চাবি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই সত্য ফর্সা হয়ে উঠেছে।
দুই
না। আমি গণক নই, এটা গণকদারি নয়। বাস্তবতার বিচার। ক্ষমতাসীনদের সম্ভাব্য পতনের প্রথম আলামত হচ্ছে সাধারণ মানুষের দোদুল্যমানতা সত্ত্বেও অবরোধ কর্মসূচির অভাবিত সাফল্য। দমন-পীড়নের মুখে অবরোধ ধীরে ধীরে স্তিমিত না হয়ে বরং আরো জোরদার হচ্ছে। ঢাকা শহরে থেকে যা বুঝে ওঠা কঠিন। সরকারকে বিজিবি মোতায়েন করতে হয়েছে, বেসরকারি প্রশাসন আর সামাল দিতে পারছে না।
দ্বিতীয় আলামত হচ্ছে নতুন করে আরো কঠোর ভাবে দমন-নিপীড়ন শুরু করবার সরকারি সিদ্ধান্ত। দমন-নিপীড়ন হত্যা-গুম নতুন কিছু নয়। কিন্তু অবরোধ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীনদের কঠোরতা কর্মসূচিকে আরো বেগবান করবে। নতুন করে কঠোর হওয়া ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক পরাজয় ও নৈতিক দুর্বলতার লণ। এটা করতে গিয়ে বিভিন্ন জেলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ নিয়োগ এবং যৌথ বাহিনীর অপারেশান চালিয়ে বিরোধী দল ও তাদের সমর্থকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, হত্যা ও গ্রেফতার রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
গুম, গুমখুন, হত্যা ও নির্যাতন নতুন কিছু নয়। ক্ষমতাসীনদের মানবাধিকার লংঘনের মাত্রা অতীতের যেকোন রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। আন্দোলনে সহিংসতা কেউই চায় না, কিন্তু ক্ষমতাসীনরা নিজেই যেখানে আইনি বিধিবিধান মানে না, নাগরিকদের মানবাধিকার নিশ্চিত করে না, সেখানে বিরোধী পরে আন্দোলন সহিংস ও বেআইনি হতে বাধ্য। যদি সাংবিধানিক বিধিবিধান শুধু বিরোধী দলেরই মান্য, ক্ষমতাসীনদের মান্য নয়, তাহলে সে ক্ষমতা সাংববিধানিক নয়। পাল্টা বলপ্রয়োগ ছাড়া তার অন্য কোন মীমাংসা নাই। বাংলাদেশে তা-ই ঘটছে। নীতিবাগিশরা বিস্তর হিতোপদেশ দিচ্ছেন দেখতে পাই। ক্ষমতাসীনদের যদি আইন ও সংবিধান মেনে চলতে আমওরা বাধ্য করতে না পারি তাহলে বিরোধী পকে এই ক্ষেত্রে হিতোপদেশ দিয়ে লাভ নাই। অবরোধ ও আন্দোলন জেলজুলুম দিয়েও দমানো যাবে না, বরং তা বাড়বে।
গতকাল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় যৌথবাহিনীর অভিযানের খবর এসে পৌঁছাচ্ছে। ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এর আগে সাতীরায় একই ধরনের অভিযানে ভারতের সীমান্তরী বাহিনীর অংশগ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল। সত্য কি মিথ্যা সেটা ভিন্ন তর্ক। মানুষ বিশ্বাস করেছে। কথা হোল, দেশের আইনশৃংখলা বাহিনী তাদের নিজেদের নাগরিকদের ওপর এই ধরনের যুদ্ধাভিযান চালায়, সেটাই বিস্ময় ও সন্দেহ তৈরি করে।
পত্রিকার রিপোর্ট হচ্ছে, “সকাল থেকে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর একাধিক দল বিভক্ত হয়ে অভিযান শুরু করে। পুরো উপজেলায় পরিচালিত হয় এ অভিযান। অভিযানে বিভিন্ন বাড়িতে তল্লাশির নামে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে কমপে ৩০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছাই হয়েছে বাড়ির আসবাবপত্র। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় পুরো এলাকা এখন পুরুষশূন্য। এলাকার সকল দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত এসব এলাকা সন্ত্রাসমুক্ত না হবে ততণ তাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে” (দেখুন দৈনিক মানবজমিন ১৬ জানুয়ারি ২০১৫)। অভিযানে ২৫ জামায়াত-বিএনপির কর্মীকে আটক করা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মতিউর রহমান (৩০) নামে এক ছাত্রদল নেতা নিহত হয়েছেন। মতিউর রহমান শ্যামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি।
এটা সম্ভবত স্পষ্ট যে বিরোধী দলের কর্মসূচি কেবল একটি কারণেই ব্যর্থ হতে পারে, যদি খালেদা জিয়া আন্দোলনে অবিচল না থেকে কোন প্রকার দোদুল্যমানতা প্রদর্শন করেন। আমার অনুমান পিছু হটে আসা তাঁর পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। তাঁকে গ্রেফতার করলেও তিনি তৃণমূলে যে সংবাদ পৌঁছয়ে দেবার, সেটা খানিক পেরেছেন। ফলে তাঁর চার দিকে ঘিরে থাকা জাতীয় নেতৃবৃন্দ তাঁর কর্মসূচি এর আগে যেভাবে বানচাল করে দিয়েছিল, তিনি অবিচল থাকলে সেটা আর সম্ভব হবে না। আন্দোলনের নেতৃত্ব অপোকৃত তরুণদের হাতে চলে যাবে। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য তার পরিণতি কী দাঁড়াবে, সেটা বলবার সময় আসে নি। তবে অবরোধ আন্দোলন আরো এক স্তর তীব্র হলে সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা।
আপাতত আমরা বোমা হাতে সন্দেহে কাউকে হত্যার চিন্তায় গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। একে ক্ষমতাসীনদের পতনের আওয়াজ গণ্য করলেও এই ধরনের মানবাধিকারবিরোধী চিন্তার নিন্দা জানানো আমাদের কর্তব্য।
ফরহাদ মজহার: কবি, কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ই-মেইল : [email protected]