মানবাধিকার পরিষদে বাংলাদেশের বৈশ্বিক উদ্যোগের স্বীকৃতি

SHARE

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশের ১৫ দফা প্রস্তাব গতকাল শুক্রবার জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদের ৪১তম অধিবেশনের শেষ দিনে প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটি পর্বে বাংলাদেশের প্রস্তাবটির ব্যাপারে কোনো দেশ আপত্তি জানায়নি। এরপর অধিবেশনের সভাপতি সবার সম্মতির ভিত্তিতে ভোট ছাড়াই প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার ঘোষণা দেন।

এর আগে সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও জেনেভায় জাতিসংঘের দপ্তরগুলোতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এম শামীম আহসান জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকার ইস্যুতে প্রস্তাবটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি জানান, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম প্রস্তাবটির পৃষ্ঠপোষক হয়েছে। এ ছাড়া ৪৩টি রাষ্ট্র এ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বলেন, এই প্রস্তাব ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কাজ করা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, আগে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যে গতিতে পড়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল বাস্তবে তার চেয়েও অনেক দ্রুত ঘটছে।

তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর দায় কম থাকলেও প্রভাব পড়ছে অনেক বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন এই দেশগুলোর মানবাধিকার চর্চা ও উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

পাকিস্তান ও ফিজির প্রতিনিধিরা তাঁদের বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রস্তাবের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও সাধুবাদ জানান। ডেনমার্কের প্রতিনিধি আশা করেন, সব রাষ্ট্র নিজ নিজ অবস্থানে থেকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ভূমিকা রাখবে এবং মানবাধিকারের প্রতি সব রাষ্ট্রই সম্মান দেখাবে।

জেনেভায় বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন জানায়, প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উদ্যোগে ঢাকায় আয়োজিত প্রতিবন্ধিতা ও দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক দুইটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত ঢাকা ঘোষণা ২০১৫ ও ২০১৫+ এর স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে বাংলাদেশ ২০০৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে গৃহীত ‘মানবাধিকার ও জলবায়ু পরিবর্তন’ শীর্ষক এ প্রস্তাবের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার যোগসূত্র নির্ণয় ও এর প্রতিকারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে করণীয় বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে।

এ প্রস্তাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাসের প্রয়াসকে প্রাধান্য দিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে ২০১৫ ও ২০১৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘প্রতিবন্ধিতা ও দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক দুইটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পর্যালোচনার বিশেষ প্রতিফলন ঘটেছে।

বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন আরো জানায়, বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অ্যাডভাইজারি প্যানেলের বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশের অটিজমবিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততায় গত বছর ঢাকায় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো ছাড়াও ৩৩টি দেশের শতাধিক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিনিধি অংশ নেন।

মানবাধিকার পরিষদে গত শুক্রবার সর্বসম্মতিতে গৃহীত ও প্রশংসিত প্রস্তাবটিতে ঢাকা ঘোষণার আলোকে একটি অনুচ্ছেদ যুক্ত হয়েছে।

প্রস্তাবে যা আছে : গৃহীত প্রস্তাবটিতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার উদ্যোগে প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আকস্মিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ধীরে ধীরে সংঘটিত বিপর্যয় এবং সব ধরনের মানবাধিকার চর্চার ওপর এসব বিপর্যয়ের বিরূপ প্রভাবের ব্যাপারে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।

সবার, বিশেষ করে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলোর ও তাদের জনগণের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে প্রস্তাবে। এর তৃতীয় দফায় জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের কাঠামোর আলোকে মানবাধিকারসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করতে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান রয়েছে।

চতুর্থ দফায় ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিট’ আয়োজনে জাতিসংঘ মহাসচিবকে সহায়তা করতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রকে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও প্রশমন নীতি প্রণয়নে ব্যাপক পরিসরে, সমন্বিত, জেন্ডার সংবেদনশীল ও প্রতিবন্ধীবান্ধব উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে পঞ্চম দফায়।

প্রস্তাবের ষষ্ঠ দফায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে এমন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে মানবাধিকার এবং প্রতিবন্ধীদের জীবিকা, খাদ্য ও পুষ্টি, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেবা উৎসাহিত করতে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে আহ্বান জানানো হয়েছে। সপ্তম দফায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে বলা হয়েছে। মানবাধিকার পরিষদের ৪৪তম অধিবেশনে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধীদের অধিকার উৎসাহিতকরণ ও সুরক্ষা’ শীর্ষক আলোচনা ও কর্মসূচি নির্ধারণের আহ্বান জানানো হয়েছে প্রস্তাবের অষ্টম দফায়। ওই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার পরিষদের ৪৬তম অধিবেশনে মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারকে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে প্রস্তাবের নবম দফায়।

দশম দফায় জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়ে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট বিশেষ দূতদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি ও মানবাধিকার পরিষদে উপস্থাপন করতে মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের প্যানেল আলোচনায় শিক্ষাবিদ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের আমন্ত্রণ জানাতে বলা হয়েছে একাদশ দফায়। প্রস্তাবের পরবর্তী দফাগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকার ইস্যুতে জাতিসংঘ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত থাকতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া জাতিসংঘ মহাসচিব ও মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারকে প্যানেল আলোচনা ও প্রতিবেদন তৈরিতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেও অনুরোধ জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ গতকাল মানবাধিকার পরিষদকে জানিয়েছে, এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে বাংলাদেশ অন্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। গৃহীত প্রস্তাবটি বাস্তবায়নে জাতিসংঘের বাড়তি দুই লাখ ৩০ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার খরচ হবে।

প্রস্তাব উত্থাপন করে বক্তব্য রাখেন সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও জেনেভায় জাতিসংঘের দপ্তরগুলোতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এম শামীম আহসান।