ছিনতাই, অপহরণ, টেন্ডারবাজির পর এবার ইয়াবা ব্যবসায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। চলতি সপ্তাহে ঢাবি’র মুহসীন হলে ১২৫০ পিস ইয়াবা ধরাপড়ার পর বিষয়টি
সামনে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগ এই ব্যবসা করলেও অনেকটা অজানা-অধরা ছিল। সম্প্রতি এই সিন্ডিকেটে ভাগ-বাটোয়ারা এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের ভাগের অংশ কমে যাওয়ায় এই ঘটনা ফাঁস করে দেয়া হয়েছে। এরপর কেঁচো খুঁড়তে সাপ পেয়েছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ।
গোয়েন্দা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র জানায়, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, এফ. রহমান হল, মুহসীন হল, শহীদুল্লাহ হল, মাস্টার দা সূর্যসেন এবং জগন্নাথ হল থেকে রাজধানীর অর্ধেকের বেশি এলাকায় মাদকের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ হয়। এই ৬টি হল থেকে ক্যাম্পাস থেকে দ্রুত বের হওয়ার পাশাপাশি হলের ছাত্রলীগের সিন্ডিকেট শক্ত। তাই এই ৬টি হলকে বেছে নেয়া হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছেন, কোন ছাত্র এই অনৈতিক কাজে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে বসে ইয়াবাসহ মাদকের ব্যবসা করে আসছে। এই সিন্ডিকেটের প্রধান নিয়ন্ত্রক মুহসীন হলের ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তাদের সার্বিক সহায়তা প্রদান করে ঢাবি ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা। এর ফলে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছে না কেউ। বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি জানলেও কোন ধরনের অভিযান চালায়নি। এমনকি হল কর্তৃপক্ষ নীরবে নিভৃতে সহ্য করে গেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মাসে মুহসীন হলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মাদক ব্যবসার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে মতপার্থক্য হয়। সেখানে সভাপতি গ্রুপ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক নেতার চাহিদা অনুসারে ভাগ দিতে রাজি না হওয়ায় এই কেন্দ্রীয় নেতা অপর গ্রুপকে প্রস্তাব দেয় পুরো ব্যবসা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ নেয়ার। বিষয়টিতে কয়েক দফা দেন-দরবার হলেও কোন সুরাহা হয়নি। এরপর সাধারণ সম্পাদক গ্রুপ সিদ্ধান্ত নেয় এই সিন্ডিকেট ফাঁস করে দেয়ার। এরই অংশ হিসেবে গত রোববার পুলিশকে খবর দেয় সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের সিন্ডিকেট। ওই সময় পুলিশকে সকল ধরনের তথ্যের পাশাপাশি আর্থিক লেনদেনও হয়। এরপর ঘটনাস্থল থেকে ১২৫০ পিস ইয়াবাসহ আটক করে ৭ জন বহিরাগতকে। পরে আটককৃত ৭ জন হল সভাপতির নাম বললেও আজ অবধি কোন ব্যবস্থা নেয়নি ঢাবি ছাত্রলীগ। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোন মামলা পর্যন্ত করেনি।
জানা গেছে, পুলিশের সামনেই আটককৃতদের মারধর করে সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের কর্মীরা। এর সঙ্গে সভাপতির লোকজন জড়িত বলে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দিতেও চাপ দেয়। এরপর সাধারণ সম্পাদক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রেক্ষাপট পাল্টানোর চেষ্টা করেন। সেই আবার আটককৃতদের মারধর করে সভাপতির সিন্ডিকেট জড়িত বলতে চাপ দেয়। এরপর পুলিশ তাদেরকে থানায় নিয়ে যায়। হল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুইজন কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রশ্রয় পেয়ে বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। কোন কিছুতেই তাদের থামানো যাচ্ছে না। সূত্র আরও বলছে, হল সভাপতির প্রশ্রয়ে দীর্ঘদিন ধরে হলে এই মাদকের ব্যবসা করছে বহিরাগত কিছু ছেলে। প্রতি মাসে এ খাত থেকে হল সভাপতিকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দেয়া হতো। সম্প্রতি এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা আশরাফ নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীর সঙ্গে মনোমালিন্যর প্রেক্ষিতে তাকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়। এরপর সেই এই ইয়াবা ব্যবসার কথা ফাঁস করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে বছর খানেক নাজমুল নামে আরেক ছাত্রলীগ কর্মী এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতো। সে বর্তমানে এই ব্যবসার বাইরে রয়েছে।
জানা গেছে, শুধু মাদক নয়, ঢাবি ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতা সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে বসে জুয়া খেলা, নেশা করা ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত থাকেন। সিন্ডিকেট নতুন করে এই উদ্যানে বসে ইয়াবার বড় চালান রাজধানীর বিভিন্ন অংশে পৌঁছায়। এর আগে চলতি বছর ৯ই মে রাতে কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক অনুপম চন্দ্র, মুহসীন হলের ছাত্র বৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক আবদুুল্লাহ আল মামুন ও কর্মী হিমেল মোবাইল ফ্লেক্সিলোড ব্যবসায়ী ফরহাদকে অপহরণ করে গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে জেল হাজতে রয়েছে। ঢাবি কর্তৃপক্ষ তাদেরকে ১১ই মে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছেন। জানা গেছে, এই চারজন ছাত্রলীগ নেতা সবাই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাজমুলের ক্যাডার বলে পরিচিত। এদের অর্থের ভাগ নাজমুল পেয়ে থাকেন। সূত্র বলছে, সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানকন্দ্রিক সব ধরনের চাঁদাবাজি, অপহরণ, ব্ল্যাকমেইলিং সহ সকল অপকর্মের সঙ্গে ঢাবি ছাত্রলীগ জড়িত। আর এরা কেন্দ্রীয় ও ঢাবি ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে এমন গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র বলছে, ঢাবি’র মুহসীন, এসএম, এফ. রহমান, জগন্নাথ, সূর্যসেন ও শহীদুল্লাহ এই ছয়টি হল থেকে রাজধানীর ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ হয়। ক্যাম্পাসকে ব্যবসার নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে সিন্ডিকেটগুলো। এর আগে এই হলগুলো থেকে অপহরণ, প্রশ্নফাঁস, ইয়াবা, মাদক বিক্রিসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। মুহসীন হলের সূত্র বলছে, এই হলের সভাপতি মাকসুদুর রহমান মিঠুর বিরুদ্ধে এর আগে একাধিক অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের কাছে করা হলেও বহাল তবিয়তে আছেন তিনি। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের আস্থাভাজন হওয়ায় সব ঘটনাই পার পেয়ে যান বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক সম্পাদক মাকসুদ, হল শাখার সাবেক কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. এএম আমজাদ বলেন, ক্যাম্পাসকে সকল ধরনের সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত রাখতে যা করা দরকার সবই করবো। এর সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত বলে অভিযোগ এসেছে বিষয়টি জানতে চাইলে বলেন, যারাই জড়িত থাকুক কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর শরীফ বলেন, ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে কোন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী সম্পৃক্ত না। বিশ্ববিদ্যালয় বসে কোন মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট করা হয় না। তারপরও যদি কোন ধরনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় তবে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হবে।
সূত্র আরও বলছে, এই ৬টি হলে নিয়মিত মাদকের আখড়া বসে। সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা এসএম ও মুহসীন হলে নিয়মিত মাদকের আখড়া বসান। সমপ্রতি পর্নো ছবি তৈরির সরঞ্জামসহ বংশালের একটি হোটেল থেকে আটক করা হয় এ হলের বেশকিছু শিক্ষার্থীকে। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় বেশকিছু নেতাকর্মীর এ ঘটনায় জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে।