শান্ত এক শুক্রবারের দুপুরে লোকজন যখন নামাজের জন্য ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে জড়ো হয়েছিল তার কিছুক্ষণ পরই শেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী এক সন্ত্রাসী অ্যাসল্ট রাইফেল হাতে দরজায় এসে দাঁড়ায়। তার হাতে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে অস্ত্র দেখা সত্ত্বেও মুসল্লিদের একজন আফগান তাকে ‘ভাই, আসুন’ বলে স্বাগত জানান। এরপরই সে বন্দুকধারী শুরু করে গুলিবর্ষণ।
এই হত্যাকাণ্ড কেবল নিউজিল্যান্ডকে ভারাক্রান্ত করেনি, বিশ্বজুড়ে মানুষকে আলোড়িত করেছে। এটা সংকেত দিচ্ছে যে প্রায় সর্বত্রই কিছু একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার বিশ্বব্যাপী বিস্তারের কারণে স্ব-ঘোষিত শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ব্যক্তি হামলা চালিয়ে ৫০ জন মুসল্লিকে হত্যার ফুটেজ সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে অনেকে।
অস্ট্রেলীয় ওই সন্ত্রাসী এবং হামলার শিকার হতাহত মুসলিমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা। যাদের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিসর, জর্ডান এবং সোমালিয়া রয়েছে। যখন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডার্ন ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর বিবৃতি প্রদানের জন্য হাজির হলেন, তখন শুধু নিউজিল্যান্ডই তার বক্তব্য শুনতে উদগ্রীব ছিল তেমন নয়। সারা বিশ্বের মনোযোগ ছিল সেদিকে।
দ্রুত এবং স্পষ্টভাবে এই বন্দুক হামলাকে তিনি ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে বর্ণনা করেন। বহু মানুষ মনে করে, শ্বেতাঙ্গ কোনো সন্ত্রাসী দ্বারা এ ধরনের হামলার ক্ষেত্রে (এমনকি সেটা যদি রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাবেও হয়ে থাকে) কর্তৃপক্ষ এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করতে অনীহা বা অনিচ্ছুক মনোভাবের পরিচয় দিয়ে থাকেন।
কিন্তু আর্ডার্ন এর দ্বারা দ্রুত, স্পষ্টভাষায় এই ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে বক্তব্য দেয়ার মাধ্যমে সে বিষয়ে তার সচেতনতা এবং বিবেচনার বিষয়টি উঠে আসে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের শোক এবং ভীতির প্রতি তার স্বীকৃতিও সেখানেই ফুরিয়ে যায়নি।
ক্রাইস্টচার্চে ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর স্বজনদের জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা ও সমবেদনা জানান তিনি। সেসময় মাথায় কালো রংয়ের স্কার্ফ পরেন তিনি; যা তাদের প্রতি শ্রদ্ধারই বহিঃপ্রকাশ। তিনি মানুষকে একতার বন্ধনে বেঁধেছেন এবং বলেছেন, তারা আমাদের।
এর কয়েকদিন পরে প্রথমবারের মত পার্লামেন্টে ভাষণ দিয়েছেন তিনি, সেখানে তিনি সংক্ষিপ্ত কিন্তু দৃঢ় ভাষায় বক্তব্য রাখেন যেখানে ইসলামী কায়দায় সবাইকে সম্ভাষণ জানান – ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে।
কিন্তু তিনি এই সহানুভূতির সাথে বাস্তবসম্মত আইনী ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতির মিশ্রণ ঘটান। হামলার কয়েক ঘণ্টার পর তিনি দেশের অস্ত্র আইনে ১০ দিনের মধ্যে কঠোর সংস্কার আনার ঘোষণা দেন। বিবিসির সাথে কথা বলার সময় তিনি নিউজিল্যান্ড এবং বিশ্ব থেকে বর্ণবাদ বিতাড়িত করার প্রতিশ্রুতি দেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সীমানা দিয়ে ভাবলে আমাদের চলবে না। আর্ডার্নের প্রথম বক্তব্যের সূত্র ধরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের পর্যবেক্ষকরা তার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানে সুজানে মুর লিখেছেন, মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, সত্যিকারের নেতারা ঐক্য খোঁজে না তারাই ঐক্য তৈরি করে, আর্ডার্ন ভিন্ন ধরনের ঐক্য তৈরি, কর্ম, অভিভাবকত্ব ও একতার প্রদর্শন করেছেন।
‘সন্ত্রাসবাদ মানুষের মাঝে ভিন্নতাকে দেখে এবং বিনাশ ঘটায়। আর্ডার্ন ভিন্নতা দেখেছেন এবং তাকে সম্মান করতে চাইছেন, তাকে আলিঙ্গন করছেন এবং তার সাথে যুক্ত হতে চাইছেন।’
ওয়াশিংটন পোস্টের ঈশান থারুর লিখেছেন, আর্ডার্ন তার জাতির শোক, দুঃখ এবং তা নিরসনের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছেন। এবিসি অস্ট্রেলিয়া ওয়েবসাইটে অ্যানাবেল ক্র্যাব লেখেন, একজন নেতার জন্য ভয়াবহ বাজে খবরের মুখোমুখি হওয়ার পর… আর্ডার্ন এখন পর্যন্ত কোনও ভুল পদক্ষেপ নেননি।
গ্রেস ব্যাক এক বাক্যে ম্যারি ক্লেয়ার অস্ট্রেলিয়াতে লিখেছেন, একজন নেতা এমনই হয়ে থাকেন। এই ধরনের প্রশংসা ব্যাখ্যা কেবল বিশ্লেষকদের কাছ থেকেই আসছে তেমনটি নয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মোহাম্মদ ফয়সাল বলেছেন, আর্ডার্ন পাকিস্তানিদের হৃদয় জয় করেছেন।
মার্টিন লুথার কিংয়ের স্মৃতি সংরক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত মার্টিন কিং সেন্টার টুইটারে লিখেছে, নিউজিল্যান্ডে একজন নেতার ভালবাসার পূর্ণাঙ্গ প্রদর্শনী। তার কথা আলোড়িত করেছে নিউজিল্যান্ডের শোকাহত পরিবারের মানুষদের।
নিউজিল্যান্ডে বিবিসির সংবাদদাতা হিউয়েল গ্রিফিথ বলছেন, আর্ডার্নের বক্তব্য- আমরা এক, তারা আমাদের, ক্রাইস্টচার্চের হতাহত পরিবারের মানুষদের মুখ থেকে শুনেছি। এমনকি বিরোধী ন্যাশনাল পার্টির জুডিথ কলিন্স প্রধানমন্ত্রী অসাধারণ বলে পার্লামেন্টে উল্লেখ করেছেন।
নিউজিল্যান্ডে রাজনৈতিক বিশ্লেষক কলিন জেমস বিবিসি নিউজকে বলেছেন, আর্ডার্নের সাথে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে তার মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী যে সমস্ত প্রশংসা বাক্য পাচ্ছেন তা বিস্ময়কর কিছু নয়। তিনি দৃঢ়, গম্ভীর, ইতিবাচক এবং দায়িত্বশীল এবং যেটা আমি প্রায়ই বলে থাকি যে, তার শরীরে কোন বাজে কোষ নেই, কিন্তু আবার তাকে সহজে প্রভাবিত করা যায় না , এটা একটা ব্যতিক্রমী সমন্বয়।
২০১৭ সালে আর্ডার্ন যখন প্রথম তার নির্বাচনী প্রচার কাজ শুরু করেন তাকে নিয়মিতভাবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাঁক্রোর সাথে তুলনা করা হতো। এর অর্থ এই তিনজনই প্রগতিশীল, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং তরুণ।
আর্ডার্ন যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন তখন তার বয়স ৩৭ বছর এবং তাকে ঘিরে ব্যাপক উন্মাদনা তৈরি হয়। যার নামকরণ করা হয় জাসিন্ডাম্যানিয়া এবং তিনি শেষ পর্যন্ত অসার পদার্থে পরিণত হন কি-না তা নিয়ে তখন অনেকেই এমনও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
সুশীল অ্যারোন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় লিখেছেন, তিনি ডানপন্থী শক্তিশালীদের ভিড়ে দৃঢ় প্রগতিশীল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে আসছেন…যার ক্যারিয়ারে গড়ে উঠেছে উদারতাহীন, মুসলিম-বিদ্বেষী আড়ম্বরের মধ্যে। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুরোধের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় যেখানে আর্ডার্নকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, আমেরিকা কী ধরনের সহায়তা দিতে পারে?
উত্তরে তিনি বলেছেন, সকল মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সহমর্মিতা এবং ভালবাসা। অস্ট্রেলিয়ার সিনেটর ফ্রেশার অ্যানিংস হামলার ঘটনার জন্য অভিবাসনকে দায়ী করে মন্তব্য করার পর তাকে সহজ ভাষায় নিন্দনীয় বলে বর্ণনা করেন তিনি।
হামলার পর দিন আর্ডার্নকে হতাহতদের পরিবারকে সান্ত্বনা দেয়া যে ছবি দেখা গেছে তা রাজনৈতিক সমসাময়িক নেতাদের আচরণের সাথে বৈপরীত্য তুলে ধরে। আল জাজিরার সাংবাদিক সানা সাইদ বলেছেন, ২০১৭ সালে কুইবেক মসজিদে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এতটা গভীর মানবিকতা দেখিয়েছেন বলে মনে পড়ছে না।
তিনি আরও বলেন, ২০১২ সালে উইসকনসিনের ওয়াক ক্রিক গুরুদুয়ারায় বন্দুক হামলার ঘটনার পর আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘটনার শিকার লোকজনের মাঝে দেখা করতে যাননি। গত বছর একটি বন্দুক হামলার ঘটনায় বিধবা হওয়া একজন নারী এমনকি ট্রুডোকে অপ্রীতিকর কোন কিছুর অংশ বলে ফোনে মন্তব্য করেন। কারণ তিনি যথেষ্ট সমবেদনা প্রকাশ করেননি বলে ওই নারী মনে করেছেন।
জেমস ব্যাখ্যা দিয়েছেন, অনেকসময় লোকজন তাকে দেখতে আকর্ষণীয় এবং সঠিক বক্তব্য দিয়েছেন বলে খারিজ করে দিতে পারেন। কিন্তু তার ক্ষেত্রে এর চেয়েও আরও বেশকিছু রয়েছে- তিনি গত কয়েকদিনে তা প্রদর্শন করেছেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অল্প কিছু মানুষ এখনো তা ধরে রাখতে পেরেছে।
সূত্র: বিবিসি