কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা ছাড়াই আকস্মিকভাবে ৫ জুন ভোর থেকে একে একে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দেয় সৌদি আরব, আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হয় স্থলযোগাযোগ, আকাশ ও সমুদ্রপথের সংযোগ। এমন সংবাদে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে কাতারবাসী। সামরিক লড়াই শুরু হওয়ার আগে শেষ মুহূর্তের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মতো ঘটনাগুলো ঘটছিল খুব দ্রুত। বেলা গড়ানোর আগে বিভেদরেখা স্পষ্ট হয়ে পড়ে উপসাগরীয় অঞ্চলের ছয়টি দেশের সম্মিলিত সংগঠন জিসিসিতে। একদিকে সৌদি আরব, বাহরাইন ও আরব আমিরাত, অন্যদিকে কুয়েত ও দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ দেশ ওমান থাকে নিরপেক্ষ অবস্থানে—একা হয়ে পড়ে কাতার।
সৌদি আরব কাতারের বিরুদ্ধে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক করার লক্ষ্যে সৌদি সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। একই ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা চালায় আরব আমিরাত ও বাহরাইন। ফলে কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা আসে মরিশাস, মালদ্বীপ, ইয়েমেন, লিবিয়া এবং মৌরিতানিয়া ও কমরোস দ্বীপপুঞ্জ থেকেও। আর সম্পর্কের মাত্রা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে জর্ডান ও জিবুতি। সর্বশেষ দোহা থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছে নাইজেরিয়া।
কিন্তু কাতারের এই একাকিত্ব বেশিক্ষণ থাকেনি। দুদিন গড়াতেই বেশ কয়েকটি দেশ কাতারের পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করে। সামরিক সৈন্য ও নিত্যপণ্য সরবরাহের ঘোষণা দিয়ে উপসাগরীয় অঞ্চলে চলমান অস্থিরতায় মূল কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে তুরস্ক। কাতারের বাজারে সৌদি আরবের দুগ্ধজাত পণ্য তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান ‘আলমারাই’র জায়গা দখল করে নেয় তুরস্কের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সৌদি আরব তার রপ্তানির অন্যতম বাজার কাতার হারালেও এ সুযোগ কাজে লাগায় তুরস্ক। পণ্য আসতে শুরু করে ইরান, আলজেরিয়াসহ অন্য বেশ কিছু দেশ থেকে। কাতারে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটিতে ১৫ হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রতিক্রিয়ায় সৌদি বিশ্লেষকেরা দাবি জানাচ্ছেন, সৌদি আরব যেন তুরস্কের বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দিদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে।
কাতারকে কেন্দ্র করে এই পরিস্থিতি এবারই প্রথম নয়। ২০১৪ সালেও এ দেশগুলো নিজেদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। সেই পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে কাতার। এরপর ২০১৬ সালে দুই দফা কাতার সফরে আসেন সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান। সর্বশেষ সৌদি আরবে অবস্থিত আরব-আমেরিকান-ইসলামি সম্মেলনেও যোগ দেয় কাতার। ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের দমনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটেও সৈন্য পাঠায় কাতার। এমন পরিস্থিতিতে পুরো সম্পর্ক পাল্টে দেয় ২৩ মে দিবাগত রাতে কাতার নিউজ এজেন্সির ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের দুর্ঘটনা।
কাতারের আমির ২৩ মে আলউদাইদ ঘাঁটিতে সামরিক সদস্যদের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে তিনি কোনো বক্তৃতা করেননি। সুযোগসন্ধানীরা বেছে নেয় এ দিনটিকে। ২৩ মে রাতে হ্যাক করার পর প্রচারিত বার্তায় বলা হয়, কাতারের আমির আলউদাইদ ঘাঁটিতে সৈন্যদের অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেছেন।
এতে কাতারের আমিরের নাম ব্যবহার করে প্রতিবেশী দেশগুলো সম্পর্কে এমন কিছু মন্তব্য প্রকাশিত হয়, যা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে। ২৪ মে কাতারের সরকারি দপ্তর আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, কাতারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে এবং এটি নিয়ে তদন্ত চলছে। যেসব বক্তব্য ও বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে, কাতার সেগুলো আগাগোড়া অস্বীকার করে।
এ সুযোগ চরমভাবে লুফে নেয় সৌদি-আমিরাতের গণমাধ্যম। হ্যাকিংয়ের মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে দেশ দুটোর টিভি স্ক্রলে আসতে শুরু করে কাতারের আমিরের ভুয়া বিবৃতি। এরপর মধ্যরাতে লাইভে আসতে শুরু করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এবং এসব উসকানিমূলক বিবৃতিকে তাঁরা জঘন্য ও কাতারের সীমা লঙ্ঘন বলে জোর প্রচারণা শুরু করেন। হ্যাকিং সম্পর্কে কাতারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও সৌদি-আমিরাত ও মিসরের গণমাধ্যম সেসব সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে। এ প্রচারণা ও তথ্যযুদ্ধ চলে ১২ দিন।
এরই মধ্যে ২ জুন সৌদি আরব সফরে যান আরব আমিরাতের যুবরাজ মুহাম্মদ বিন জায়েদ। একই দিন কাতার ঘোষণা করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআই কাতারকে হ্যাকিং তদন্তে সহযোগিতা করছে। ৩ জুন হ্যাক করা হয় ওয়াশিংটনে নিযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ আল ওতাইবার বেশ কিছু ই-মেইল। হ্যাকাররা নিজেদের গ্লোবাল লিকস নামে পরিচয় দেয়।
৫৫ পৃষ্ঠার এসব ই-মেইল ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মে মাস পর্যন্ত মার্কিন বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়। এতে আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূতের কাতার সম্পর্কে বেশ কিছু বিরূপ মন্তব্য ছিল। বিশেষ করে আলউদাইদ ঘাঁটি সরিয়ে নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ ও প্ররোচিত করেন আল ওতাইবা। এক বার্তায় তিনি বলেন, তোমরা কাতারকে জাহান্নামের স্বাদ বুঝিয়ে দাও। এই ই-মেইল ফাঁসের পর কাতার স্তম্ভিত হয়ে পড়ে, ভ্রাতৃপ্রতিম ও প্রতিবেশী দেশ আরব আমিরাতের আচরণে।
আরব আমিরাত এসব ই-মেইলের সত্যতা অস্বীকার করেনি। বরং এসব নিয়ে আল জাজিরা যখন বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করে এবং পরিস্থিতি ক্রমেই আরব আমিরাতের প্রতিকূলে যেতে থাকে, তখনই আসে চূড়ান্ত পদক্ষেপ। ৫ জুন ভোর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় কাতারকে। অভিযোগ তোলা হয়, কাতার এ অঞ্চলে জঙ্গিবাদ প্রচার করছে এবং উগ্রপন্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে।
পবিত্র রমজানে কাতারকে বয়কট করার এমন আকস্মিক ঘোষণায় অবাক হয়ে পড়ে উপসাগরীয় অঞ্চলবাসী। সৌদি, আমিরাত ও বাহরাইনে অধ্যয়নরত কাতারি শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাবর্ষ অসম্পূর্ণ রেখে কাতারে ফিরে এসেছেন তাঁরা। এক কাতারি স্বামীকে দুবাইয়ে তাঁর আমিরাতি স্ত্রীর কাছে যেতে না দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে দুবাই। আবার ওই স্ত্রীকেও দোহা যেতে বারণ করেছে দুবাই কর্তৃপক্ষ। দোহায় স্বামী ও সন্তান ছেড়ে দুবাইয়ে একা পড়ে আছেন স্ত্রী, এমন অমানবিক আরও বেশ কিছু ঘটনা ঘটছে এই অঞ্চলে। পাশাপাশি যেসব কাতারি নাগরিকের সহায় সম্পত্তি আছে সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও বাহরাইনে, তাঁদেরও প্রবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এই সম্পর্কচ্ছেদের ফলে কেবল আঞ্চলিক বাণিজ্য বা কূটনীতির ক্ষতি নয়; বরং সাধারণ মানুষের পারিবারিক জীবন, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন এবং ব্যক্তিগত অধিকারের ক্ষেত্রগুলোতেও ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এক কাতারি মা সৌদি আরব থেকে ফিরে আসার সময় তাঁর কাছ থেকে প্রতিবন্ধী শিশুকে কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ করেছেন, কারণ শিশুটির বাবা সৌদি নাগরিক হওয়ায় শিশুটিও সৌদি জাতীয়তার। ফলে তাকে ছাড়াই মাকে সৌদি আরব ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এমন চার শর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ অভিযোগ দায়ের করেছেন কাতারের জাতীয় মানবাধিকার কমিটির কাছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইতিমধ্যে এক বিবৃতিতে এ পরিস্থিতির নিন্দা জানিয়েছে।
সর্বশেষ কাতারের সঙ্গে সম্পর্কিত ৫৯ জন ব্যক্তি ও ১২টি সংস্থাকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তালিকা প্রকাশ করেছে সৌদি জোট। এ নিয়েও রয়েছে নানা কথা। তালিকায় ১৯ নম্বরে থাকা ব্যক্তি আল্লামা ইউসুফ আলকারজাভি আড়াই মাস আগেও সৌদি আরবে সম্মানিত অতিথি হিসেবে মক্কায় এক সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন, সৌদি গ্র্যান্ড মুফতির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রয়াত বাদশাহ আবদুল্লাহর কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন সৌদি আরবের সর্বোচ্চ পুরস্কার বাদশাহ ফয়সাল পদক। এ ছাড়া আরব আমিরাতের মাকতুম শাসক পরিবারের দেওয়া সম্মাননা এবং এক মিলিয়ন দিরহামের পুরস্কারও পেয়েছেন এই কারজাভি। এই তালিকায় আছেন সাংবাদিক, লেখক, বিশ্লেষক, ধর্মীয় পণ্ডিত ও সমাজকর্মী।
এই পরিস্থিতিতে যেকোনো মূল্যে আল জাজিরার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করতে চায় সৌদি আরব। কাতারকে দেওয়া শর্তের তালিকায় প্রথমেই আছে এই চ্যানেলের নাম। তালিকায় রয়েছে আলআরাবি টিভি, আলআরাবিআলজাদিদ পত্রিকা, মিডলইস্ট আই এবং আরাবি টোয়েন্টি ওয়ান ওয়েবসাইটও বন্ধ করার শর্ত দেওয়া হয়েছে কাতারকে। আরও আছে হামাস ও ইখওয়ানের (মুসলিম ব্রাদারহুড) নেতাদের কাতার থেকে বহিষ্কার ও তাঁদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার শর্ত। তেহরানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ও উপসাগরীয় অঞ্চলের অভিন্ন পন্থা মেনে চলার দাবিও মেনে নিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে কাতারকে। এসবের জবাবে কাতার এখন পর্যন্ত বলে আসছে, পররাষ্ট্রনীতিতে কারও চাপিয়ে দেওয়া উপদেশ তারা মানবে না।
সাড়ে ১১ হাজার বর্গকিলোমিটারের ছোট দেশ কাতার বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয়ের দেশ। ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজক কাতারে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। দিন দিন উদার ও সাহসী হয়ে ওঠা কাতারের পররাষ্ট্রনীতিকে তাই রুখতে চাইছে সৌদি-আমিরাত জোট। ইসরায়েলের দৌরাত্ম্যের চেয়ে এই অঞ্চলের কনিষ্ঠতম আমির এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমকে থামিয়ে দেওয়াই মনে হয় তাঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিরূপ পরিস্থিতিতেও আরব আমিরাতকে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে কাতার। আবুধাবির বিদ্যুৎ উৎপাদনে অর্ধেক গ্যাসের জোগান দিচ্ছে কাতারের প্রতিষ্ঠান ডলফিন।
একই ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং জীবনাচারের দেশগুলোর মধ্যে যে বিভেদরেখা টেনে দিচ্ছে সৌদি আরব, তাতে করে উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনৈতিক আবহ পাল্টে যাচ্ছে। জিসিসি সংস্থাটির আর কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখছেন না বিশ্লেষকেরা। পাশাপাশি কেউ কেউ বলছেন, আরব আমিরাত ও সৌদি আরবকে উসকে দিয়ে সুবিধা হাতিয়ে নিতে চাচ্ছে সুযোগসন্ধানী মিসর। খুশি ইসরায়েলও। সাধারণত আরবদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে কোনো পক্ষাবলম্বন না করার যে নীতি ছিল ইসরায়েলের, তা ভুলে কাতারের বিরুদ্ধে মনোভাব প্রকাশ করেছে দেশটি।
কাতার চেষ্টা করছে, আলোচনার টেবিলে এই সমস্যার সমাধান হোক। কিন্তু কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি-আমিরাত ও বাহরাইনের জঙ্গিবাদের অপবাদ ও তথ্যসন্ত্রাসের আশ্রয় নেওয়া উপসাগরীয় অঞ্চলে কী ধরনের ফলাফল বয়ে আনবে, এর ওপর নির্ভর করছে পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্ব রাজনীতির অনেক কিছুই।