কক্সবাজারের উখিয়ায় স্থানীয় এক ইউপি সদস্যে র সহযোগিতায় বনভূমি দখল করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের জন্যর গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন বস্তি।
বন কর্মকর্তাদের অভিযোগ, পালংখালী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল আবছারের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ একটি চক্র বন বিভাগের বাধা উপেক্ষা করে ওই বস্তি গড়ে তুলছে। তাদের উদ্দেশ্যভ, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওই ঝুপড়ি ভাড়া দিয়ে মাসে মাসে টাকা আদায়ের ব্যতবস্থা করা।
আর উখিয়া উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবছার বলছেন, তিনি এটা করেছেন ‘মানবিক বিবেচনায়’, টাকা আদায়ের জন্যয় নয়।
মিয়ানমারে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে গত শতকের ৮০ এর দশক থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শিরণার্থী আশ্রয় নিয়ে আছে বাংলাদেশে।
কক্সবাজারের দুটি ক্যািম্প থেকে তাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে বার বার আহ্বান জানানো হলেও মিয়ানমার ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এরই মধ্যেে গত অক্টোবরে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সেনাবাহিনী দমন অভিযান শুরু হলে বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নতুন ঢল নামে। তখন থেকে অন্তত ২৭ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয়ের আশায় বাংলাদেশে ঢুকেছে বলে জাতিসংঘের তথ্যব।
নতুন আসা এই রোহিঙ্গারা কুতুপালংয়ের নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্প ছাড়াও আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় অবৈধভাবে ঘর তুলছে।
গত কিছুদিন ধরে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালীর নাইন্ন্যার ঘোনা পাহাড়ি এলাকায় সামাজিক ও সংরক্ষিত বনভূমি দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন বস্তি।
সেখানে চার শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবার ইতোমধ্যে অবস্থান নিয়েছে এবং আরও নতুন ঝুপড়ি তৈরি হচ্ছে বলে বন বিভাগের কর্মীদের তথ্যষ।
উখিয়ার রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, ইউপি সদস্য আবছারের নেতৃত্বে বালুখালীর পাহাড়ি এলাকার বনভূমি দখল করে রোহিঙ্গাদের জন্যী বস্তি বানানোর খবরে কয়েক দিন আগে অভিযান চালান তারা।
“তারপরও সংঘবদ্ধ চক্রটি অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের বস্তি গড়ে তুলতে ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে। বন বিভাগের অভিযানের পরও নাইন্ন্যার ঘোনায় গত বুধবার নতুন একটি বস্তি তৈরি হয়েছে।”
সরেজমিনে দেখা যায়, বালুখালীর পাহাড়ি এলাকায় বনভূমির গাছ কেটে খুঁটি, বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে বানানো হয়েছে অন্তত চারশ ঘর। পাশের কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প থেকে এসে সাত হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। নতুন আরও ঘর বানানো চলছে।
নতুন বসতিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে আরও অনেককে গাছের নিচে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
নতুন গড়ে ওঠা এসব ঝুপড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রভাবশালী ওই চক্র ঘর দেওয়ার জন্য পরিবার প্রতি আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা নিয়েছে। প্রত্যে ক ঘরের জন্যব মাসে ৩০০ টাকা করে ভাড়া দিতে হবে বলে তাদের জানানো হয়েছে।
বালুখালীতে গড়ে উঠা নতুন বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার মংডু থানার কুমিরখালী এলাকার আনোয়ারা বেগম (২০)।
মাসখানেক আগে স্বামী শাহাব উদ্দিনকে মিয়ানমারের সেনারা ধরে নিয়ে গেলে সাত মাসের সন্তানসহ মামার সঙ্গে পালিয়ে এসে প্রথমে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যা ম্প, পরে এই ঝুঁপড়িতে আশ্রয় পান আনোয়ারা।
তিনি বলেন, বুধবার বনবিভাগের কর্মীরা অভিযান চালিয়ে তার এবং আশপাশের বেশ কিছু ঘর গুঁড়িয়ে দিয়ে যায়। এরপর স্থানীয় এক ব্যক্তিকে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে নতুন এই ঘর পেয়েছেন তিনি।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের তমব্রু সীমান্ত পার হয়ে গত সোমবার কুতুপালংয়ে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে পৌঁছান মংডুর নাইচাপ্রু এলাকা থেকে চার সন্তানসহ পালিয়ে আসা লায়লা বেগম (৩২)।
তিনি বলেন, এপারে আসার পর হাতে যে টাকা ছিল তা দিয়ে কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যা ম্পের পাশে পাহাড়ি এলাকায় একটি ঝুপড়ি তুলেছিলেন। কিন্তু বন বিভাগের কর্মীরা গত বুধবার ওই ঘর ভেঙে দিয়ে যায়।
“পরে ইউপি মেম্বারের সহযোগিতায় এইখানে (বালুখালী) জায়গা পাইছি। কিন্তু টাকা নাই, ঘর তুলতে পারতেছি না।”
বালুখালীর পাহাড়ি এলাকায় গড়ে ওঠা নতুন এই রোহিঙ্গা বস্তির ১ নম্বর ব্লকের মাঝি (সর্দার) করম আলী ও ৪ ব্লকের মাঝি খলিলুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
তারা জানান, এক সপ্তাহের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের আশপাশের এলাকায় পাঁচ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা জড়ো হয়েছিলেন। তাদের অনেকেই কুতুপালং ক্যাম্পের আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় ঝুপড়ি তুলে আশ্রয় নেন।
কিন্তু গত বুধবার বন বিভাগের লোকজন উচ্ছেদ অভিযান চালালে তারা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। পরে তাদের জায়গা হয় নতুন বস্তিতে।
করম আলী জানান, বালুখালীর ইউপি সদস্য নুরুল আবছার শুক্রবার সকালে এসে নতুন বস্তির ঘরগুলোকে সাতটি ব্লকে ভাগ করে সাতজনকে মাঝি হিসেবে মনোনীত করেন। তাদের ওপর ঘরগুলোর ব্যববস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
টাকা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন ঘর বানানো হয়েছে, তাই ‘কিছু টাকা’ নেওয়া হচ্ছে।
ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী নুরুল আবছার অবশ্য টাকা আদায়ের কথা অস্বীকার করেছেন।
টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কুতুপালংয়ে অনিবন্ধিত বস্তির আশপাশের পাহাড়ে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিতে পারলে এখানে থাকতে অসুবিধা কোথায়? মানবিক দিক বিবেচনা করে আমার এলাকায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেছি মাত্র।”
এদিকে পালংখালী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মো. গফুরুল্লাহর আশঙ্কা, সীমান্তলাগোয়া এই পাহাড়ি এলাকায় নতুন বস্তির খবর পেলে আরও রোহিঙ্গা সেখানে আসার চেষ্টা করবে।
“অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের রাখার বিষয়টি নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখা জরুরি ছিল। কিন্তু প্রশাসন সেই ব্যবস্থা না নেওয়ায় রোহিঙ্গারা সীমান্ত সংলগ্ন বনভূমিতে ছড়িয়ে পড়ছে।”
উখিয়ার ঘাট বন বিট কর্মকর্তা মো. মোবারক আলী বলেন, ২০১২-১৩ থেকে ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে গড়ে তোলা আড়াই শতাধিক একর সামাজিক বনায়নের জমিতে বিভিন্ন স্থানে রোহিঙ্গাদের বস্তি গড়ে উঠছে। বনকর্মীরা উচ্ছেদ করেও থামাতে পারছে না।
রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম জানান, কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে গত বুধবার বনকর্মীরা ৮০টির বেশি ঘর উচ্ছেদ করেন।
“তারা ফেরার সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ইন্ধনে রোহিঙ্গারা বনকর্মীদের উপর হামলা চালালে আমাদের ১০ জন আহত হন।”
ওই ঘটনায় উখিয়া থানায় শুক্রবার একটি মামলা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
মনিরুল বলেন, “ইউপি সদস্য নুরুল আবছার অতি উৎসাহী হয়ে বালুখালীর বন দখল করে রোহিঙ্গাদের বসাচ্ছে। বিষয়টি বিভাগীয় বনকর্মকর্তাকে অবহিত করা হয়েছে।”
আবছার ছাড়াও কুতুপালং এলাকার ইউপি সদস্য বখতিয়ার আহমদ বন দখল করে ঘর তোলার কাজে মদদ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুল।
পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “রোহিঙ্গাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যারা পুনর্বাসন করছে- প্রশাসন ইচ্ছে করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে। তা না হলে আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে কেন্দ্র করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।”