গ্রিন রোড দিয়ে কারওয়ান বাজার যাওয়ার পথে সবুজ রঙের বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। গেটের সামনে বেশ বড় একটি হলুদ রঙের সাইনবোর্ড টাঙানো। এতে লেখা, ‘এই কমপ্লেক্সের কোনো ফ্ল্যাট ব্যাচেলর ভাড়াটিয়ার নিকট ভাড়া দেওয়া যাইবে না’।
পশ্চিম কারওয়ান বাজারে প্রতীক কাজী গার্ডেন এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে ঢোকার মুখেও বিজ্ঞপ্তি ঝোলানো। এতেও আছে ব্যাচেলর বা অবিবাহিত ব্যক্তিদের কাছে বাড়ি ভাড়া না দেওয়ার কথা।
রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া নেওয়া বেশ ঝক্কির ব্যাপার। আর তা যদি হয় ব্যাচেলরদের জন্য, তবে তো কথাই নেই। বাড়ির মালিককে রাজি করানো যেমন কঠিন, তেমনি কঠিন নানা বিধি-নিষেধের মধ্যে টিকে থাকা। সাম্প্রতিক সময়ের জঙ্গি হামলার পর ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে নতুন করে কড়াকড়ি বেড়েছে। এর মধ্যে গুলশানের হলি আর্টিজান, শোলাকিয়ায় হামলার পর পুলিশ দুজন বাড়িওয়ালাকে গ্রেপ্তার করার পর বাড়ি মালিকদের মধ্যেও ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়া নিয়ে ভীতি জন্মেছে। সর্বশেষ কল্যাণপুরে একটি বাড়ির ‘জঙ্গি আস্তানায়’ পুলিশের অভিযানে নয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় এবং বাড়িওয়ালাকে গ্রেপ্তারের কারণে ভবিষ্যতে রাজধানীতে ব্যাচেলরদের ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরও বাড়তে পারে।
তরুণ ব্যবসায়ী মতিউর রহমান বলেন, এক মাস ধরে হাতিরপুল, কাঁঠালবাগান ও ভূতের গলি এলাকায় বাসা খুঁজছেন তিনি। কিন্তু পরিবার না থাকায় এখনো বাসা জোটেনি। তিনি বলেন, সবখানেই বাড়ির মালিকেরা ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দিতে ইতস্তত করেন। অনেক সময় দেখা গেছে, বিজ্ঞপ্তি দেখে ফোন দেওয়ার পর ব্যাচেলর শুনেই লাইন কেটে দিয়েছেন। মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার অভিজ্ঞতাও হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর শেষ করে এখন আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন গোবিন্দ বিশ্বাস। প্রায় দেড় মাস ধরে বাড়ি খুঁজছেন। তিনি বলেন, সব ব্যাচেলর তো আর একরকম হয় না। কারও কারও সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাড়ির মালিকেরা ভাড়া দিতেই চান না। অনেকে এমনও বলেন যে পরিবার নিয়ে আসুন। আর বাসা পেলেও দেখা যায়, মান অনুযায়ী ভাড়া বেশি চাওয়া হয়। যে বাসা সাধারণত ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকায় পাওয়া যায়, তার ভাড়া দাঁড়ায় ২৫ হাজার টাকায়।
উত্তরার সেক্টর-১০ এলাকায় পাঁচতলা বাড়ি আছে একরামুল্লাহ মাহমুদের। দুই কক্ষের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে চান তিনি। তাঁর প্রথম পছন্দ ছোট পরিবার। ব্যাচেলরের প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, তাঁর বাড়িতে সব ফ্ল্যাটই বিভিন্ন পরিবারকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ব্যাচেলরদের দিতে গেলে অন্য ভাড়াটে আপত্তি করেন।
মোহাম্মদপুরে বাড়ি আছে মো. আনোয়ার হোসেনের। তিনি বলেন, ব্যাচেলরদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ একটু কম থাকে। তা ছাড়া অন্য যেসব ভাড়াটে পরিবার নিয়ে থাকেন, তাঁরা নানা অভিযোগ করেন। এসব কারণেই ব্যাচেলরদের ভাড়া দেওয়া হয় না।
অবশ্য ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো বিধিনিষেধ নেই। বাড়িওয়ালাদের কোনো ভীতি থাকাও উচিত নয়। পুলিশ বলেছে যাদেরই (ব্যাচেলর-ফ্যামিলি) বাসা ভাড়া দেওয়া হোক না কেন, সেই তথ্য পুলিশকে জানাতে। যে দুজন বাড়িওয়ালাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা ভাড়াটের তথ্য জানাননি। এখানে ব্যাচেলর বা ফ্যামিলি ভাড়া নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা নেই।
প্রতীক কাজী গার্ডেন এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক মো. আবু তাহের বলেন, ব্যাচেলরদের ফ্ল্যাট ভাড়া দিলে নানা ধরনের সমস্যা হয়। তা ছাড়া অন্যান্য ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকা পরিবারগুলোরও সমস্যা হয়। ব্যাচেলরদের কাছে নানা সময় নানা ধরনের অপরিচিত লোক আসে। ফলে ঠিকমতো হিসাব রাখা যায় না। তিনি জানান, সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পর ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া পরিবারগুলোর কাছে আসা বিভিন্ন অতিথির পরিচয়ও তালিকা করে রাখা হচ্ছে।
তেজগাঁওয়ে পশ্চিম কারওয়ান বাজারের প্রতীক কামিনী এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান বলেন, ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া দিলে নানা অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হতে হয়। সেসব এড়াতেই ব্যাচেলরদের ভাড়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফ্ল্যাট মালিকেরা। সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পুরো কমপ্লেক্স সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
গোলাম মাহমুদের মিরপুরে বাড়ি আছে। তিনি বলেন, মূলত নিরাপত্তার কারণেই ব্যাচেলরদের ভাড়া দেওয়া হয় না। ব্যাচেলর ভাড়া দিয়ে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। অনেকে রাতে দেরি করে বাসায় ফেরে। অনেকে আবার রাতবিরাতে লাউড স্পিকারে গান শোনে, গিটার বাজায়। এসব নিয়ে অন্য ভাড়াটেরা অভিযোগ করেন।
ব্যাচেলর নারীরা বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে মুখোমুখি হন ভিন্ন বিড়ম্বনার। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত নুসরাত জাহান জানান, এ কারণে কিছুদিন আগেই বাসায় ওঠার এক মাসের মধ্যে তাঁকে তা ছাড়তে হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘বাড়ির মালিক আমাদের হুট করেই বাসা ছাড়তে বলেন। আর ভাড়া নিতে গেলে তো শুনতে হয় অনেক অযাচিত প্রশ্ন। বেশির ভাগ মালিকই ভাড়া দিতে চান না। আর ভাড়া পেলে মানতে হয় হাজারটা নিয়মকানুন। অবস্থা দেখে মনে হয়, আমাদের বিনা মূল্যে থাকতে দেওয়া হচ্ছে।’
বেসরকারি সংস্থায় চাকরিরত সাদিয়া মোবাশ্বেরা জান্নাত বলেন, বাড়ির মালিকেরা বাসা ভাড়া দিতেই চান না। আর বন্ধুদের নিয়ে থাকতে গেলে আরও সমস্যা হয়। কেন ঢাকায় আত্মীয় নেই, এমন প্রশ্নও শুনতে হয়। অনেক চেষ্টার পর মিরপুরে একটি বাসা পেয়েছেন বলে জানালেন সাদিয়া। কিন্তু সেখানেও মানতে হচ্ছে অনেক শর্ত, শুনতে হয় অহেতুক অনুযোগ।
এ ব্যাপারে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে (ক্যাব) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাসা ভাড়া না পেয়ে এমন কোনো অভিযোগ এখনো তাদের কাছে আসেনি। তবে বাড়ির মালিকের সঙ্গে ভাড়াটেদের অগ্রিম টাকার লেনদেন ও ভাড়ার চুক্তি নিয়ে নানা অভিযোগ আসে।