প্রশ্নটা ঘুরছে বিসিবির আনাচকানাচে। বোর্ড কর্মকর্তাদের মস্তিষ্কেও জাগাচ্ছে অস্বস্তিকর অনুভূতি। অক্টোবর আসতে এখনো আড়াই মাসের মতো বাকি। সেটা ভাবলে ইংল্যান্ড দল বাংলাদেশ সফরে আসবে না ধরে নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বিসিবি যে ঘরপোড়া গরু! সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
নিরাপত্তার অজুহাতে গত বছর অস্ট্রেলিয়া দল বাংলাদেশে আসেনি। হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর ইংল্যান্ড সিরিজ নিয়েও গোপনে একই শঙ্কার চোরাবালি জেগে উঠছে। গুলশান হামলার পর ইসিবি জানিয়েছে, সফরের আগের এই কয়টা মাস বাংলাদেশের ওপর তারা তীক্ষ্ণ নজর রাখবে। আসবে নিয়মিত নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক দলও। তবু বিসিবি অন্তত প্রকাশ্যে আশাবাদী যে, ইংল্যান্ড দল বাংলাদেশ সফর করবে। দ্বিপক্ষীয় সিরিজের আগে বিভিন্ন বিষয়ে দুই বোর্ডের মধ্যে নিয়মিত যেসব আলোচনা হয়, সেগুলোও নাকি চলমান।
ইংল্যান্ডের পর বাংলাদেশের সম্ভাব্য ঘরোয়া সিরিজ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ২০১৭-এর জুন-জুলাইয়ে হওয়ার কথা ২০১৫-এর বকেয়া সিরিজটি। কিন্তু ইংল্যান্ড না এলে দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়ার আসাটাও পড়ে যাবে ঘোর অনিশ্চয়তায়। বাংলাদেশকে ক্রিকেটের জন্য অনিরাপদ বলা তখন আরও সহজ হবে তাদের জন্য।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই সিরিজ তাই বদলে দিতে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎই। দুই টেস্ট ও তিন ওয়ানডের সিরিজটি ঠিকঠাকভাবে হলে ভবিষ্যৎ এক রকম, না হলে বা ইংল্যান্ড দল না এলে অন্য রকম। বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা প্রধান আকরাম খানের কণ্ঠে সিরিজ আয়োজনের তাড়না সে জন্যই এত স্পষ্ট, ‘আমরা এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে বিশ্বকাপ আয়োজন করেছি। ঘরোয়া ক্রিকেটেও এসব জিনিস কখনো প্রভাব ফেলেনি। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশকে এবারও আমরা ক্রিকেটের জন্য নিরাপদ প্রমাণ করতে পারব।’ তা ছাড়া ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের সঙ্গে টেস্ট খেলার সুযোগ খুব বেশি পায় না বাংলাদেশ দল। বিসিবির এই পরিচালকের ইংল্যান্ড দলের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকার এটাও একটা কারণ, ‘আমরা অনেক দিন ধরে এই সিরিজ নিয়ে পরিকল্পনা করছি। বাংলাদেশ দলের জন্য ইংল্যান্ডের আসাটা তাই খুবই জরুরি।’
ইংল্যান্ড দলের বাংলাদেশ সফর সন্ত্রাসের কালো থাবার নিচে পড়বে না, বিসিবির মতো এই আশা বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের। এমন আশার পেছনে সবচেয়ে বড় স্বার্থ এ দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। নিরাপত্তাশঙ্কায় ইংল্যান্ড না এলে সেটার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। গুলশান হামলার কিছু কালো ছায়া তো এর মধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। বিসিবি সূত্র জানিয়েছে, বেশ খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পরও হলি আর্টিজানের সন্ত্রাসী ঘটনার পর শ্লথ হয়ে গেছে জাতীয় দলের নতুন বোলিং কোচ নেওয়ার প্রক্রিয়া। সশস্ত্র দেহরক্ষী দেওয়া হচ্ছে বিসিবির বিদেশি কোচ-ট্রেনারদের। ইংল্যান্ড বাংলাদেশে আসতে না চাইলে সিরিজটি নিরপেক্ষ কোনো ভেন্যুতে হবে কি না, সেই প্রশ্নও উঠে গেছে এর মধ্যেই।
সবচেয়ে বড় সমস্যা, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য নিরাপদ নয়’ রবটা একবার ছড়িয়ে পড়লে সেটা থামানো সহজ হবে না। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঘরোয়া ক্রিকেটও। বিপিএলের কথাই ধরুন। ঘরোয়া এই টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের চাকচিক্যের অনেকটাই বিদেশি ক্রিকেটারদের আলোতে। উপমহাদেশ তো বটেই; অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দেশগুলোর ক্রিকেটাররাও খেলতে আসেন এই টুর্নামেন্টে। ক্রিকেট-ভেন্যু হিসেবে বাংলাদেশের মানচিত্রে লাল দাগ পড়ে গেলে বিপিএল নিয়ে তাদের মধ্যে কি আগের উৎসাহটা থাকবে? সংশ্লিষ্ট বোর্ড তাদের ক্রিকেটারদের বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেবে কেন!
সব প্রশ্নের উত্তরই নির্ভর করছে ইংল্যান্ড দলের বাংলাদেশ সফরে আসা বা না আসার ওপর। বিসিবি ওপরে ওপরে আশাবাদী মনোভাব দেখালেও সংশয় ঠিকই দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ইংল্যান্ড সিরিজের প্রসঙ্গ তুললেই স্পষ্ট হচ্ছে তা। বিসিবিতে খুবই স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে এ-সংক্রান্ত আলোচনা। নিরাপত্তা বিভাগ থেকে শুরু করে জাতীয় দলের খেলোয়াড়—বিষয়টা নিয়ে নির্দোষ কোনো মন্তব্যও করতে রাজি নন কেউ। ইংল্যান্ড সিরিজ নিয়ে কথা না বলতে নাকি কড়া নির্দেশ আছে বিসিবি থেকে।