ফরমালিন পরিমাপের যন্ত্র নিয়ে খোদ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে মতবিরোধ ও বিভ্রান্তি রয়েছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস কনজুর্মাস অ্যাসোসিয়েশন ( বিএফএফসিএ)।ল্যাবরেটরি টেস্ট ছাড়া ফলে ফরমালিন মিশানোর অজুহাতে ফল ধ্বংস করে কৃষক, ফল ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে করেছে এই অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনটি।
শনিবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ করে বিএফএফসিএ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস্ কনজুর্মাস অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ড. আবদুল ওয়াদুদ। এতে বিশেষজ্ঞের বক্তব্য দেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োক্যামিস্ট্রি ও মোলেকুলার বায়োলোজির প্রফেসর ড. ইশতিয়াক মাহমুদ, রসায়ণ বিভাগের প্রফেসর ড. নিলুফার নাহার এবং বুয়েটের ক্যামিক্যাল বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড. মুহিদুস সামাদ খান।
ড. আবদুল ওয়াদুদ বলেন, “গত কয়েক বছর ধরে ফলে ফরমালিনের উপস্থিতি সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রকাশ হয়ে আসছে তার অধিকাংশই বিভ্রান্তিকর। এসব তথ্য জনমনে ফল সম্পর্কে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। ইতিমধ্যে অনেকেই ফল খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। চাষীরা ফল চাষে নিরুৎসাহিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেক ফল আমদানিকারক ইতিমধ্যে আমদানি করা বন্ধ করে দিয়েছেন, খুচরা ব্যবসায়ীরা তাদের পুঁজি হারিয়ে পথে বসার উপক্রম। ফল নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গড়িয়েছে যে ফল যেন একটি অভিশাপ। বিষয়টির প্রকৃত রহস্য ও সত্যতা উদ্ঘাটন করা এখন সমায়ের দাবি।”
তিনি বলেন, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দৈনিক ১৫০ গ্রাম ফল গ্রহণ করা উচিত। ফলের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ও মিনারেল্স, যা রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শিশুদের মেধা ও শারীরিক বিকাশে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। অসুস্থ রোগীদের রোগ নিরাময় ও শারীরিক শক্তি বৃদ্ধিতে ফলের কার্যকারিতা সবচেয়ে বেশি। গর্ভবতী মায়েদের জন্য ফলের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমানে ফল নিয়ে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের সবারই জানা। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এই মুহূর্তে আমাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমাদের সত্য ঘটনা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে।”
ড. আবদুল ওয়াদুদ বলেন, “আমরা ফল বিক্রেতা, উৎপাদক ও আমদানিকারক কারো পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলতে এখানে আসিনি। সত্য সবসময় সত্য। আমরা সত্য ও সঠিক তথ্য তুলে ধরতে চাই। ভোক্তাদের ফল সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করতে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। অসাধু ব্যবসায়ী, অসাধু আমদানিকারক ও অসাধু উৎপাদক শাস্তির আওতায় আসুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।”
তিনি বলেন, “বিশ্বের কোনো দেশে ফল নিয়ে এরকম বিভ্রান্তি ও তুলকারাম নজির নেই। সর্বকালের সর্বযুগে মানুষের খাদ্য তালিকায় ফল ছিল ও আছে। হঠাৎ ফলে এমন কী হলো ! কাদের স্বার্থে ফল সম্পর্কে এরূপ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হচ্ছে তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। ফল নিয়ে সমস্যা হলে শুধু বাংলাদেশেই নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশেও হতো।”
ড. আবদুল ওয়াদুদ জানান, কৃষকদের দাবি ফরমালিন কি তা তারা চেনেন না, এ সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না। বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক, ওষুধ ও ক্যামিক্যাল তারা একজনের দেখাদেখি আরেকজন প্রয়োগ করে আসছেন। এই ব্যাপারে কেউ তাদের মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা ও সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। খুচরা বিক্রেতাদের দাবিÑ দিনে ফল ক্রয় করে নিয়ে ও দিনে বিক্রি করে দেয়। বাড়তি টাকায় ফরমালিন কিনে ফলে মিশিয়ে অতিরিক্ত লাভ করার প্রশ্নই উঠে না। আমদানিকারকদের দাবি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, দক্ষিণ-আফ্রিকা, চীন থেকে হিমায়িত কন্টেইনারে ফল এনে নিজস্ব কোল্ড স্টোরেজ এ রেখে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করা হয়। বর্তমান প্রযুক্তিতে ফল এক বছরেও বেশি সময় সংরক্ষণ করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে ফরমালিন মেশানোর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। তাহলে ফরমালিনের বিভ্রান্তি কোথায়? বিভ্রান্তি শুধু মাত্র একটি জায়গায় তা হলো দেশীয় ফলের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্ত ভোগীরা (ফরিয়া) এহেন কাজ করে ভোক্তাদের প্রতারিত করছে। তাছাড়া ফরমালিন ডিটেকটার মেশিন বাড়তি ঝামেলা করে মানুষকে বিভ্রান্তি করছে।”
ড. আবদুল ওয়াদুদ অভিযোগ করেন, “বিভিন্ন জায়গার ফল পরীক্ষার রিপোর্ট বিভিন্ন রকম। সাইন্স ল্যাবরেটরি টেস্টের রিপোর্ট একরকম, বিএসটিআই টেস্টের রিপোর্ট আরেক রকম, আইপিএইচ এর রিপোর্ট আরেক রকম, বিদেশী ফ্রুট সেফটির রিপোর্ট আরেক রকম, তাৎক্ষণিক ফরমালিন ডিটেকটার মেশিনের রিপোর্ট আরেক রকম। কোনটি যে সত্য আর কোনটি যে মিথ্যা তা আমাদের ভোক্তা সাধারণের জানার অধিকার রয়েছে। টেস্ট রিপোর্ট পৃথিবীর সব জায়গায় একই হওয়ার কথা।”
তিনি জানান, জেড ৩০০ মেশিন দিয়ে বাংলাদেশের ফলমূলে ফরমালডিহাইড-এর উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। কিন্তু উক্ত মেশিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের ভাষ্যমতে, ‘এই মেশিন শুধুমাত্র বাতাসে ফরমালডিহাইডের বাষ্প নিরূপণ করতে সক্ষম।’ ব্লাড সুগার পরীক্ষা করার জন্য শরীরের রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করতে হয়। শরীরের বর্হিবিভাগের কোন মেশিন স্থাপন করে যেমন ব্লাড সুগার নির্ণয় করা যায় না ঠিক তেমনি ফলের বাইরে কোনো মেশিন স্থাপন করে ভিতরে কী উপাদান আছে তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। ফল ভেঙে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। তখনই শুধুমাত্র জানা সম্ভব এই ফলের মধ্যে কী ক্ষতিকারক উপাদান রয়েছে।
“আমাদের আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার থাকা সত্ত্বেও যেমন (বিসিএসআইআর, পিএইচআই) কেন এই যন্ত্র ব্যবহার করে তাৎক্ষণিক একটি সিদ্ধান্ত দিয়ে সাধারণ কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ফল ধ্বংস করা হচ্ছে তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। এভাবে কৃষক, ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব পড়বে আমাদের সার্বিক অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যসেবায়।”- বলেন ড. আবদুল ওয়াদুদ।
ড. আবদুল ওয়াদুদ বলেন, “আপনারা জানেন, আমাদের দেশে অনেক পাখি ফল খেয়ে বেঁচে থাকে। ফলে কোনো ক্ষতিকারক ক্যামিক্যাল মিশানো হলে পাখিদের বংশ বৃদ্ধি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে ক্ষতিকারক কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত ক্যামিক্যাল মিশানোর কারণে অনেক পাখি ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমাদের দেশে অনেকেই বিদেশী পাখিদের লালন-পালন করে থাকেন। বিদেশী পাখিদের প্রধান খাদ্য ফল। ফলের ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যে ধর্মঘট ডেকেছেন, আমদানিকারকরা ফল আমদানি বন্ধ করে দেওয়ার পায়তারা করছেন । এই পরিস্থিতিতে এইসব বিদেশী পাখিরাও মানুষের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।” সার্বিক পরিস্থিতিতে ফল সম্পর্কে সরকারকে এখনই একটি সঠিক সমাধানে আসার জোর দাবি জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে বিএফএফসিএ’র পক্ষ থেকে ১০টি দাবি জানানো হয়। এগুলো হলো: সাধারণ ভোক্তাদের জন্য কম খরচে ও সহজে ফলে ফরমালিনের উপস্থিতির মাত্রা চিহিৃতের ব্যবস্থা করা। ফরমালিন পরিমাপের যন্ত্র নিয়ে খোদ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে যে মতবিরোধ ও বিভ্রান্তি রয়েছে তা দূর করা। রাজধানীসহ সারা দেশের মার্কেটগুলোকে ফরমালিন মুক্ত ঘোষণা ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ । প্রাকৃতিকভাবে কোন ফলে কী মাত্রার ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে তা জনগণকে অবহিত করা। ল্যাবরেটরি টেস্ট ছাড়া ফলে ফরমালিন মিশানোর অজুহাতে ফল ধ্বংস করে কৃষক, ফল ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের ক্ষতিগ্রস্ত না করা। খুচরা বাজারে ফরমালিন ও ক্ষতিকারক ক্যামিক্যাল বিক্রি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা। ফলে বিষাক্ত ক্যামিক্যালের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ এবং তার ক্ষতিকর দিকগুলো শনাক্তকরণের বিষয়ে উন্নতমানের ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা এবং গবেষকদের সহায়তা করা। ফল উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় মাঠপর্যায়ে ফল চাষীদের কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো। ফলসহ বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক ক্যামিকেল ও ফরমালিন মিশানো হলে দায়ী ব্যক্তিদের আইন করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।