গ্রিসে ‘না’ ভোটের জয়

SHARE

greec voteঋণদাতাদের শর্ত মেনে হাত পেতে ত্রাণ নিতে নারাজ গ্রিস। রোববারের গণভোটে সেই প্রস্তাবে ‘না’ করে নিজের চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়ানোর শপথ নিল গ্রিস।

খরচ কমিয়ে, কর বাড়িয়ে ইউরোপ -আইএমএফের ত্রাণের অর্থ নেওয়া, না কি আলাদা ভাবে ঋণদাতাদের সঙ্গে রফা- এই প্রশ্নেই রোববার ঐতিহাসিক গণভোটে সামিল হয় গ্রিস। আর তাতেই সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় গিয়েছে ‘না’ ভোটের দিকেই। ফলে প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাসের ‘না’ ভোট দেওয়ার আর্জিতেই মানুষ সাড়া দিয়েছেন বলে গ্রিস সরকারের দাবি।  ত্রাণ প্রকল্প মেনে নিয়ে ‘হ্যাঁ’ ভোট দেওয়ার শিবির দৌড়ে পিছিয়ে ছিল প্রথম থেকেই।
গ্রিস সরকারের দাবি, এই ‘না’ ভোট গণতন্ত্রের জয়। এর জেরে তাদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বার করে দিতে পারবে না জোটের বাদবাকি ১৮টি সদস্য দেশ। তা করতে গেলে বাধা হবে আইনই। গ্রিক অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘‘অভিন্ন ইউরো মুদ্রার ১৯ দেশের এই জোট থেকে কাউকে আলাদা করা আইনবিরুদ্ধ।’’ যদিও ঋণদাতাদের অনেকেই বলেছেন, এর পরে আর ইউরো ব্যবহার করে জোটে থাকতে পারবে না গ্রিস। অনিশ্চয়তা গ্রাস করবে প্রায় দেউলিয়া গ্রিসের অর্থনীতিকে।

সরকারি সূত্রের খবর, এ দিন বিপুল সাড়া মিলেছে ভোটে। ফলে ৪০ শতাংশের কম ভোট পড়লে রায় গ্রহণযোগ্য না-হওয়ার আশঙ্কা ছিল না। আনুষ্ঠানিক ভাবে বুথ ফেরত সমীক্ষা হয়নি। তবে গ্রিসের সময় সন্ধে ৭টায় ভোট শেষ হওয়ার পরেই সে দেশের প্রধান ছ’টি টেলিভিশন চ্যানেলের সমীক্ষাতেই ত্রাণ প্রকল্প মেনে নেওয়ার বিপক্ষে গ্রিক জনগণ রায় দিচ্ছেন বলে ইঙ্গিত মিলেছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে ইঙ্গিত, কম বয়স্ক থেকে শুরু করে পেনশনপ্রাপক এবং একেবারেই নিম্নবিত্তরা ‘না’ ভোটকেই বেছে নিয়েছেন। মধ্যবয়স্ক ও মধ্যবিত্তরা এবং বামপন্থী সরকারের কট্টর বিরোধীরা ত্রাণের পক্ষেই ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছেন।

গত পাঁচ বছর ধরে চলতে থাকা মন্দার জেরে আর্থিক সঙ্কটে নাজেহাল ১৯টি দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম সদস্য গ্রিস। বাদবাকি ইউরোপ, ইউরোপীয় শীর্ষ ব্যাংক এবং আইএমএফের কাছ থেকে ত্রাণ প্রকল্প খাতে ঋণ নিয়ে খুঁড়িয়ে চলা অর্থনীতি। বেকারত্বে জেরবার সাধারণ মানুষ। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে টান। খরচ কাটছাঁট করতে গিয়ে প্রশাসন চালাতে হিমশিম সরকার। এই পরিপ্রেক্ষিতে ঋণদাতাদের কড়া শর্ত মানলে তবেই মিলত পরবর্তী দফার ত্রাণ। সরকারি খরচ আরও কমানো ও কর বাড়ানোর শর্তে ওই ঋণ পাওয়া নিয়েই উভয়সঙ্কটে ছিল গ্রিস।
চরম ব্যয়সঙ্কোচের পথ থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েই জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসেন বামপন্থী নেতা ৪০ বছর বয়স্ক সিপ্রাস। অপমানজনক জীবনযাত্রা থেকে বেরিয়ে এসে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতেই গ্রিকদের ‘না’ ভোট দেওয়া উচিত বলে আর্জি জানিয়েছিলেন তিনি।
‘না’ শিবিরই জয়ী হওয়ায় গ্রিস সরকার আইএমএফ ও অন্যান্য ঋণদাতার সঙ্গে আলাদা ভাবে রফায় আসতে তৎপর হবে বলে জানিয়েছে। অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারুফাকিস দাবি করেছেন, খুব তাড়াতাড়ি তা সম্ভব হবে। প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাসও মনে করছেন, এর পরে ঋণদাতাদের সঙ্গে অনেক বেশি দর কষাকষি করতে পারবে গ্রিস।
গত এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ থাকা গ্রিসের সব ব্যাঙ্কেই নগদ তলানিতে। ইউরোপীয় শীর্ষ ব্যাঙ্ক (ইসিবি) জরুরি ভিত্তিতে তহবিল না-জোগালে সেগুলি কাজ শুরু করতে পারবে না। এ ব্যাপারে জোটের অন্য দেশগুলির সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেবে ইসিবি। সিপ্রাস ইতিমধ্যেই টেলিফোনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁকোয়া হল্যান্ডে-র সঙ্গে কথা বলেছেন। জি-৭ জানিয়েছে, তারা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছে। জার্মান চান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল এবং হল্যান্ডে সোমবার বৈঠকে বসছেন।
এ দিকে রাজকোষ কিছুটা অন্তত ভরাতে মরিয়া গ্রিস সরকার কালো টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করছে। সুইস ব্যাঙ্কে যে-সব গ্রিকের অ্যাকাউন্ট আছে, তাঁরা অঘোষিত আয়ের উপর এককালীন ২১% কর দিলেই আর কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে না এথেন্স।
বিশ্লেষকেরা বলেছেন, গত কয়েক মাসের নিষ্ফলা আলোচনার পর বেইল আউট কর্মসূচি নিয়ে নিজেদের মত দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রিসের আশপাশের দেশসহ সমস্ত ইউরোপীয় দেশেই বড় প্রভাব ফেলেছে।

জার্মান কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনসের জুলিয়ান রাপল্ড বলেন, ‘বেইল আউট কর্মসূচি নিয়ে ঋণদাতাদের সঙ্গে গ্রিসের ভবিষ্যৎ আলোচনার ওপর এ নির্বাচনের প্রভাব ব্যাপক।’ তিনি বলেন, গ্রিস যদি ইউরোজোন ছেড়ে যায় তবে সংকট নিরসনে ইইউর প্রচেষ্টার এক ব্যর্থতাই হবে সেটি।

আর ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী ইমানুয়েল ম্যাক্রোন বলেছেন, একটা সমঝোতায় পৌঁছার জন্য গ্রিস এবং আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের চেষ্টা চালাতেই হবে।

‘হ্যাঁ’ ভোটের অর্থ
সরকারের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে যাবে। নতুন নির্বাচন আহ্বান করা হতে পারে। অথবা জাতীয় সরকার গঠিত হতে পারে। ‘হ্যাঁ’-এর পক্ষে বিপুল সমর্থন থাকলে পুরস্কারস্বরূপ ঋণদাতারা আর্থিক সহায়তা আবার চালু করতে পারে। নতুন নির্বাচন হলে সেটির সম্ভাব্য সময় সেপ্টেম্বর মাস। সেই নির্বাচনে সিপ্রাস আবার বিজয়ী হতে পারেন। গ্রিক নাট্যের নতুন চক্রের আবার শুরু হতে পারে।

‘না’ ভোটের মানে
ঋণদাতারা তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বলেই মনে করবে। তারা বলেছে, ‘না’-এর মানে আলোচনার সব পথ শেষ। তাদের কাছ থেকে আরও আর্থিক সহায়তা পাওয়ার পথও বন্ধ হবে। এ মাসের মধ্যে ইসিবির ৩০০ কোটি ইউরোও ফেরত দিতে হবে। গ্রিসকে ইউরোজোন থেকে বের করে দেওয়া হতে পারে। অনেকের মতে, এর ফলে সামাজিক সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে।

সংকট যেভাবে তৈরি হলো
যে ঋণসংকট নিয়ে গ্রিসে এখন টালমাটাল অবস্থা, তার শুরু আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। এই সময়ের মধ্যে নানা চড়াই-উতরাই প্রত্যক্ষ করেছে দেশটি। ২০০৯ সালের অক্টোবরে সরকার প্রথম স্বীকার করে প্রত্যাশার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে গ্রিস।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আইএমএফের কাছে পরের বছরের এপ্রিলে সাহায্যের আবেদন করে এথেন্স। ওই বছরের মে মাসে ইউরোজোনের প্রথম দেশ হিসেবে গ্রিস ইইউ ও আইএমএফের কাছ থেকে আর্থিক পুনরুদ্ধার (বেইলআউট) প্যাকেজ গ্রহণ করে। তারা এথেন্সকে ১১০ বিলিয়ন ইউরো দেয়। বিনিময়ে এথেন্স বেতন কর্তন ও কর বৃদ্ধির মতো যেসব পদক্ষেপ নেয়, তার চড়া মূল্য দিতে হয় জনগণকে।

২০১১ সালের অক্টোবরে অর্থনৈতিক অবস্থা আরও অবনতি হওয়ায় ১৩০ বিলিয়ন ইউরোর দ্বিতীয় বেইলআউট প্যাকেজ প্রস্তাব ঘোষণা করে ইউরোজোন। যেসব শর্তে ইইউ ও আইএমএফ ঋণ দিয়েছিল, তা পুনর্বিবেচনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে পার্লামেন্ট নির্বাচনে বড় জয় পায় আলেক্সিস সিপ্রাসের নেতৃত্বাধীন ব্যয়-সংকোচনবিরোধী সিরিজা পার্টি। এরপর ফেব্রুয়ারিতে গ্রিস ও ঋণদাতাদের মধ্যে মতৈক্য হয় যে জুন পর্যন্ত ঋণসহায়তা অব্যাহত রাখা হবে। বিনিময়ে বিভিন্ন সংস্কার পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এথেন্স।

গত ২ জুন সংস্কার প্রশ্নে গ্রিসকে চূড়ান্ত প্রস্তাব দেয় ঋণদাতারা। প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস তা প্রত্যাখ্যান করেন। ২৭ জুন সিপ্রাস ঋণদাতাদের সর্বশেষ প্রস্তাবের ওপর গণভোট অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন।