যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের ফলে সারা দেশেই এখন থেকে সমকামীদের মধ্যে বিয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
স্বাধীনতা আর সমানাধিকার প্রশ্নে নজির গড়ল আমেরিকা। সম্প্রতি আয়ার্ল্যান্ডে গণভোটের মাধ্যমে সমকামী সম্পর্ক বৈধতা পেয়েছে। আর এ বার আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিল, বিয়ে করার অধিকার রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে। সেই মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে বঞ্চিত করা হবে না সমকামীদের। শীর্ষ আদালতের এই রায়ে এ বার থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যেই আইনি বৈধতা পেল সমকামী বিয়ে।
শীর্ষ আদালতের এই রায়ে দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বলেছেন, ‘‘প্রেম তো প্রেমই। এই রায়ে সমানাধিকার পেলেন মার্কিন নাগরিকেরা। আজ আরও একটু বেশি স্বাধীন হলাম আমরা সবাই।’’
এত দিন আমেরিকার ৫০টি রাজ্যের মধ্যে ৩৭টিতে আইনত বৈধ ছিল সমকামী বিয়ে। আজ থেকে এগারো বছর আগে আমেরিকায় প্রথম সমকামী বিয়ের সম্মতি দিয়েছিল ম্যাসাচুসেটসের আদালত। তথ্য বলছে, মার্কিন নাগরিকদের ৭০ শতাংশই এমন রাজ্যগুলিতে বাস করে যেখানে সমকামী বিয়ে বৈধ। তবে এত দিন সেই অধিকার থেকে ব্রাত্য ছিল ৩০ শতাংশ। শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের ন’জন বিচারপতি মধ্যে ভোটাভুটি হলে ৫-৪ ভোটে জয়ী হয় সমকামী বিয়ের অধিকার।
তার পরে বিচারপতি অ্যান্টনি এম কেনেডি বলেন, ‘‘সমকামী দম্পতিরা এখন থেকে আমেরিকার যেকোনো রাজ্যে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন। বিয়ে তাদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। এই স্বাধীনতা আর তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হবে না।’’ রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়েন সাধারণ মানুষ। বিচারপতিরা জানিয়েছেন- রাষ্ট্র যখন এক, তখন সেই রাষ্ট্রের সর্বত্রই বলবৎ হবে এক আইন। ওই বেঞ্চের রায়েই আজ থেকে আমেরিকার সর্বত্র সাংবিধানিক বৈধতা পেল সমকামী আইন। এই রায় দিতে গিয়ে কয়েকটি পুরনো মামলার প্রসঙ্গও তুলে আনেন বিচারপতিরা। মিশিগান, ওহায়ো, কেনটাকির মতো বেশ কয়েকটি রাজ্যে গত বছর দায়ের হওয়া কিছু মামলার কথা উল্লেখ করেন বিচারপতিরা। যেখানে সমকামী বিয়েকে বৈধতা দেওয়া তো হয়ইনি, উল্টে তার বিরোধিতা করে লাগাতার সওয়াল করা হয়েছে। বিচারপতিরা জানিয়ে দেন, আমেরিকার সংবিধান এমন কোনও বাধা-নিষেধের কথা বলে না। আদালত আরও জানিয়েছে, কোনও রাজ্য যদি সমকামের বিপক্ষে যায় তবে সেই পদক্ষেপ অসাংবিধানিক বলে গণ্য করা হবে।
সমকামী বিয়ের স্বীকৃতি চেয়ে দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে শীর্ষ আদালতের এমন রায়ে স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত দেশবাসী। অভিভূত সমাজককর্মী থেকে এলজিবিটি (সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামীদের সংগঠন) কর্মীরা। তাদের অনেকেই বলছেন, আমেরিকার দু’শো বছরের ইতিহাসে এমন রায় এই প্রথম। সাধারণ মানুষের অধিকার আর জীবনধারণের স্বাধীনতার এমন স্বীকৃতি নজিরবিহীন। এক সমাজকর্মীর কথায়, ‘‘এই প্রজন্মের কাছে এটা এক ঐতিহাসিক রায়। নতুন করে স্বাধীন হলাম আমরা। সামাজিক অধিকারের প্রশ্নে লিঙ্গ পরিচয় আর বিভেদ তৈরি করবে না। সমাজে সমান মর্যাদা পাবেন সবাই। এটাই তো স্বাধীনতা!’’
মার্কিন সংবাদ সংস্থা জানাচ্ছে, যে মামলার রায় দিতে গিয়ে এই ইতিহাস তৈরি হয়েছে, তার সূত্রপাত বেশ কয়েক বছর আগে। মৃত স্বামীর ডেথ সার্টিফিকেটে নিজের নাম দেখতে না পেয়ে ওহায়োর বাসিন্দা জিম ওবেরগেফাল হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ওই সমকামী দম্পতির অধিকার রক্ষার লড়াই শেষমেশ পৌঁছয় সুপ্রিম কোর্টে। ওই মামলাকে সামনে রেখেই আজকের রায়।
এই নিয়ে ওবামা বলেন, ‘‘এই রায়ে জয় হলো আমেরিকার। এবার আমরা বলতে পারব, আমদের যুক্তরাষ্ট্রকে আমরা আরও একটু নিখুঁত ভাবে গড়তে পেরেছি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষ যেটা মনে মনে বিশ্বাস করে এসেছেন, চেয়ে এসেছেন, আজ তা বৈধতা পেল। যাঁরা দিনের এই পরিবর্তন আনতে লড়াই করেছেন, এটা তাদের জয়।’’ জিম ওবেরগেফালকেও সাধুবাদ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট।
তবে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় নিয়ে প্রশ্নও তুলছেন অনেকে। তাদের দাবি, সমকামী বিয়েকে বৈধতা দিতে গিয়ে আদতে বিয়ে প্রতিষ্ঠান নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেওয়া হচ্ছে। তবে বিচারপতি কেনেডি রায়ের খসড়ায় দাবি করেছেন, বিয়ে প্রতিষ্ঠানকে সম্মান দিতেই এই অধিকার সকলের কাছে পৌঁছনো প্রয়োজন। তিনি লিখেছেন, ‘‘বিয়ে প্রেম, বিশ্বাস, সমর্পণ, ত্যাগ, পরিবারের প্রতীক। ওরা (সমকামীরা) বিয়ে প্রতিষ্ঠানকে সম্মান করেন না বললে ভুল হবে। সম্মান করেন বলেই এর অংশ হতে চান।’’ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন জি রবার্টস লিখেছেন, ‘‘আপনি যদি মার্কিন নাগরিক হন, যে কোনও যৌন অভিমুখের পক্ষে হয়ে যদি সমকামীদের বিয়ের অধিকার সমর্থন করেন, তবে আজকের রায় উদ্যাপন করুন!’’
তথ্য বলছে, এই রায়ে আমেরিকা বিশ্বের ২১তম দেশ যেখানে সার্বিক ভাবে স্বীকৃত হল বিয়ের সমানাধিকার। সমকামী বিয়েকে সারা দেশে আইনি বৈধতা দিয়েছে ইউরোপের কয়েকটি দেশও। তবে এই অধিকারে এখনও বঞ্চিত ভারত। আমেরিকার মতোই সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যার ক্ষমতা রয়েছে ভারতের শীর্ষ আদালতের হাতেও। আমেরিকায় সমকামী সম্পর্ক আগেই স্বীকৃতি পেয়েছিল। এক দেশ যখন সমকামী সম্পর্ক থেকে সমকামী বিয়ের বৈধতা উদ্যাপন করছে, অন্য দিকে সমকামী সম্পর্কটাও অপরাধ-মুক্ত হতে পারছে না!