চারদিকে প্রচণ্ড গরম। মানুষ গরমের উত্পাতে দিশেহারা। বিশেষ করে যাদেরকে বাধ্য হয়ে প্রচণ্ড গরমে খোলা মাঠে চলাফেরা বা কায়িক পরিশ্রম করতে হয়। গরমে অনেক বিপদের মাঝে সবেচেয় ভয়াবহ অবস্থার নাম হিট স্ট্রোক।
হিট স্ট্রোক কি : গরমের দিনের একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যগত সমস্যার নাম হিট স্ট্রোক। চিকিত্সা শাস্ত্র অনুযায়ী প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে তাকে হিট স্ট্রোক বলে।
হিট স্ট্রোক কাদের বেশি হয় : প্রচণ্ড গরমে ও আর্দ্রতায় যে কারোর হিট স্ট্রোক হতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যেমন— শিশু ও বৃদ্ধ। এদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রৌদ্রে কায়িক পরিশ্রম করেন তাদের ঝুঁকি বেশি।
হিট স্ট্রোকের লক্ষণসমূহ : তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে দেহে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রাথমিকভাবে হিট স্ট্রোকের পূর্বে অপেক্ষাকৃত কম মারাত্মক হিট ক্র্যাম্প অথবা হিট এক্সহসশন হতে পারে। হিট ক্র্যাম্পে শরীরের মাংসপেশী ব্যথা করে, দুর্বল লাগে এবং প্রচণ্ড পিপাসা লাগে। এরপরের ধাপে হিট এক্সহসশনে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, মাথা ব্যথা, ঝিমঝিম করা, বমি ভাব, অসংলগ্ন আচরণ ইত্যাদি দেখা দেয়। এই দুই ক্ষেত্রেই শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ঠিক থাকে এবং শরীর প্রচণ্ড ঘামতে থাকে। এ অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়া হলে হিট স্ট্রোক হতে পারে। এর লক্ষণসমূহ হল— শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রী ফারেন হাইট ছাড়িয়ে যায়, ঘাম বন্ধ হয়ে যায়, ত্বক শুষ্ক ও লালাভ হয়ে যায়, নিঃশ্বাস দ্রুত হয়, নাড়ীর স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়, রক্তচাপ কমে যায়, খিচুনী, মাথা ঝিমঝিম করা, অস্বাভাবিক ব্যবহার, হ্যালুসিনেশন, অসংলগ্নতা ইত্যাদি। প্রসাবের পরিমাণ কমে যায়, রোগী শকেও চলে যেতে পারে। এমনকি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
প্রতিরোধের উপায় : গরমের দিনে কিছু সতর্কতা মেনে চললে হিট স্ট্রোকের বিপদ থেকে বেঁচে থাকা যায়। এগুলো হলো— হালকা ঢিলেঢালা কাপড় পরুন। কাপড় সাদা বা হাল্কা রঙের হতে হবে। সুতি কাপড় হলে ভাল, যথাসম্ভব ঘরের ভিতরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকুন, বাইরে যেতে হলে মাথার জন্য চওড়া কিনারাযুক্ত টুপি, ক্যাপ বা ছাতা ব্যবহার করুন, বাইরে যারা কাজকর্মে নিয়োজিত থাকেন, তারা মাথায় ছাতা বা মাথা ঢাকার জন্য কাপড় জাতীয় কিছু ব্যবহার করতে পারেন, প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল পান করুন। মনে রাখবেন, গরমে ঘামের সাথে পানি ও লবণ দুই-ই বের হয়ে যায়। তাই পানির সাথে সাথে লবণযুক্ত পানীয় যেমন খাবার স্যালাইন, ফলের রস, লাচ্ছি ইত্যাদিও পান করতে হবে। পানি অবশ্যই ফুটানো হতে হবে, তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী পানীয় যেমন— চা ও কফি যথাসম্ভব কম পান করা উচিত, রোদের মধ্যে শ্রমসাধ্য কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। এসব কাজ সম্ভব হলে রাতে বা খুব সকালে করুন। যদি দিনে করতেই হয়, তবে কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম নিতে হবে ও প্রচুর পানি ও স্যালাইন পান করতে হবে।
আক্রান্ত হলে করণীয় : প্রাথমিকভাবে হিট স্ট্রোকের পূর্বেই যখন হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সহসশন দেখা দেয়, তখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে হিট স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব। এক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই যা করতে পারেন তা হচ্ছে— দ্রুত শীতল কোন স্থানে চলে যান। যদি সম্ভব হয় ফ্যান বা এসি ছেড়ে দিন, ভেজা কাপড়ে শরীর মুছে ফেলুন। সম্ভব হলে গোসল করে নিন, প্রচুর পানি ও খাবার স্যালাইন পান করুন। যদি হিট স্ট্রোক হয়েই যায়, তবে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। ঘরে চিকিত্সা করার কোন সুযোগ নেই।
এক্ষেত্রে রোগীর আশেপাশে যারা থাকবেন তাদের করণীয় হল— রোগীকে দ্রুত শীতল স্থানে নিয়ে যাওয়া, তার কাপড় খুলে দিন, শরীর পানিতে ভিজিয়ে দিয়ে বাতাস করুন। এভাবে তাপমাত্রা কমাতে থাকুন, সম্ভব হলে কাঁধে, বগলে ও কুচকিতে বরফ দিন, রোগীর জ্ঞান থাকলে তাকে খাবার স্যালাইন দিন, দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করুন, সব সময় খেয়াল রাখবেন হিট স্ট্রোকে অজ্ঞান রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস এবং নাড়ী চলছে কিনা। প্রয়োজন হলে কৃত্রিমভাবে নিঃশ্বাস ও নাড়ী চলাচলের ব্যবস্থা করতে হতে পারে।
হিট স্ট্রোকে জীবন বিপদাপন্ন হতে পারে। তাই এই গরমে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে এর থেকে বেঁচে থাকা উচিত।
লেখক:ডীন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়