দীর্ঘ ১৭ বছর পর বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসভবন পর্যন্ত সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এর অংশ হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সদরদপ্তর থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকি করা হবে, মাঠ পর্যায়ে মোতায়েন থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্স (সিএসএফ) ও পুলিশ সমন্বিতভাবে তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করবে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, বাসা, অফিস এলাকা ও চলাচল পথ ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে তারেক রহমানের জন্য। নিরাপত্তায় বিন্দুমাত্র ঘাটতিও যেন না হয় তার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে প্রশাসন। বিশেষ করে তার প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে যেসব রাস্তায় ঝুঁকি রয়েছে বা রাজধানীর যেসব এলাকায় ঝুঁকি রয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। প্রয়োজনে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া তারেক রহমানের চলাচলের পথের নিরাপত্তাও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার এ কার্যক্রম ডিএমপি সদরদপ্তর থেকেই তদারকি করা হবে।
গোয়েন্দা সূত্রে আরও জানা যায়, তারেক রহমানের দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উচ্চ পর্যায়ের একাধিক বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকের একটিতে নেতৃত্ব দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেই। এতে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) থেকে শুরু করে গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরাও উপস্থিত ছিলেন। উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে তারেক রহমানের দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার ঝুঁকিগুলো বিবেচনা করা হয়। সে অনুযায়ী পরবর্তীতে কঠোর নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তার ধারাবাহিকতায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রস্তুত করা হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছেও এ সংক্রান্ত নির্দেশ এসেছে।
জানা গেছে, বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে তারেক রহমানের নিরাপত্তায় ডিএমপি প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে সার্বিক নিরাপত্তার মূল দায়িত্বে থাকছে বিএনপি চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্স (সিএসএফ)। তারা পুলিশ ও বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘিরে মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) মধ্যরাত থেকে পুলিশের পাহারা শুরু হওয়ার কথা। গোয়েন্দা পুলিশ, সাদা পোশাকে ও পোশাকধারী পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন স্তরে নিরাপত্তায় থাকবেন। ২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমান দেশে ফেরার দিনে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তিনশ ফিট হয়ে এভারকেয়ার হাসপাতাল ও গুলশান অ্যাভিনিউর বাসভবন পর্যন্ত পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থার প্রায় কয়েক হাজার সদস্য মোতায়েন করা হবে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত প্রতিটি থানা এলাকায় পুলিশি নিরাপত্তা থাকবে। সঙ্গে থাকবে পুলিশের ‘স্পেশাল স্কট’। এ ছাড়া মোড়ে মোড়ে পুলিশি চেকপোস্ট রাখা হবে। বর্তমানে গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় অন্তত নয়টি চেকপোস্ট রয়েছে। এসব চেকপোস্টে ২৪ ঘণ্টায় দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। তারেক রহমান দেশে ফেরায় গুলশান এলাকায় অন্তত তিনটি চেকপোস্ট বাড়তে পারে। তার বাসা ও আশপাশের এলাকায় প্রতিদিন দেড় শতাধিক পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য মোতায়েন থাকবেন। বাসভবন থেকে কোথাও যাতায়াতে পুলিশি নিরাপত্তা চাইলে সেক্ষেত্রেও বাড়বে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তখন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার তিন শতাধিক সদস্য নিরাপত্তায় যুক্ত থাকবেন।
সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থাটি কেন্দ্রীয়ভাবে ডিএমপির সদরদপ্তর থেকে তদারকি করা হবে এবং সেখান থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে। সে নির্দেশনা অনুযায়ী ডিএমপির গুলশান ও উত্তরা বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাবেন।
এ বিষয়ে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. শাহরিয়ার আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদরদপ্তর থেকে সরাসরি তদারকি করা হবে তারেক রহমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিশেষ কোনো বিভাগ বা ডিভিশন এ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে না। ডিএমপির পক্ষ থেকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হবে, সে হিসাবে তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর গুলশান অ্যাভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসায় উঠবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাসভবন ‘ফিরোজা’র দেয়াল ঘেঁষেই এ বাসা। গুলশান অ্যাভিনিউর বাসাটি তারেক রহমানের জন্য প্রায় প্রস্তুত। কোনো কারণে সেটি পুরোপুরি প্রস্তুত না হলে তিনি তার মা খালেদা জিয়ার ভাড়া বাসা ফিরোজায় উঠবেন। দেশে ফেরার পর গুলশানের ৮৬ নম্বর রোডে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকেই তিনি দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
ডিএমপির গুলশান বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাসভবন ফিরোজা ও তারেক রহমানের বাসভবন পাশাপাশি হওয়ায় দুটি বাসা ও তার অফিসকে একই নিরাপত্তা পরিকল্পনার আওতায় আনা হচ্ছে। বিশেষ করে বাসা ও অফিসের মধ্যকার দূরত্ব ও চলাচলের পথকে নিরাপত্তা পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) রওনক আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। পুলিশ সদরদপ্তর থেকেও একটা নিরাপত্তা নির্দেশিকা দেওয়া হবে। ডিএমপি সদরদপ্তরের সেন্ট্রালি একটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দেশে আসার পরিকল্পনা ছিল তারেক রহমানের। কিন্তু সেসময় নিরাপত্তাজনিত কারণে তার আর দেশে আসা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তখন কেবল তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরিকল্পনায় ছিলেন। সেই পরিকল্পনা তখন মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন শুরু হয়নি বলে বাতিল করতে হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ঢাকা শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচশ অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকে। সেই সংখ্যা সামনে আরও বাড়তে পারে। এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিরাপত্তায় স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) দায়িত্ব পালন করছে। বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। কোনো কারণে তারেক রহমানের বাসা প্রস্তুত না হলে তিনি মায়ের বাসা ফিরোজায় উঠবেন। সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়াও যদি সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন তাহলে বাসায় অবস্থানকালে এসএসএফের নিরাপত্তা পেতে পারেন তারেক রহমান। তখন তার নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে এসএসএফ, সিএসএফ ও পুলিশের সমন্বয়ে নিরাপত্তা কাঠামো আরও জোরদার হবে।
সম্প্রতি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এ কে এম শামছুল ইসলামকে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছে বিএনপি। তারেক রহমানের নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে তার নিরাপত্তার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে আগামী ২৫ ডিসেম্বর বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের কথা রয়েছে। দেশে ফেরার জন্য তিনি ইতোমধ্যে ট্রাভেল পাস পেয়েছেন। বিমানের টিকিটও কাটা হয়েছে। তারেক রহমানের দেশে ফেরাকে ঘিরে বিএনপি ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এই প্রত্যাবর্তনকে স্মরণীয় করে রাখতে দলীয় নেতাকর্মীদের সক্রিয় করা হয়েছে।
তারেক রহমানের দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেনের যাত্রী ছাড়া সহযাত্রীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এসএম রাগিব সামাদের পাঠানো এক বার্তায় এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
বার্তায় বিমানবন্দর জানায়, ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিমানবন্দর এলাকায় যাত্রী ব্যতীত সব ধরনের সহযাত্রী ও ভিজিটর প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
যাত্রীসেবা, নিরাপত্তা ও অপারেশনাল শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে বিশেষ অপারেশনাল ও নিরাপত্তাজনিত কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, উল্লিখিত সময়ের মধ্যে শুধু বৈধ টিকিটধারী যাত্রীদের বিমানবন্দর এলাকায় প্রবেশের অনুমতি থাকবে।




