জুলাই অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয় জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট আসামির বিচারকাজ শেষ হয়েছে। আগামী ২০ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। এর মধ্যদিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দ্বিতীয় কোনো মামলার রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছেন ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর আজ বুধবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায়ের এই দিন ধার্য করেন।
ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এই মামলায় আট আসামির মধ্যে চার জন পলাতক। হাবিবুর রহমান ছাড়া পলাতক অন্য আসামিরা হলেন ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল পলাতক। আর গ্রেপ্তার থাকা চার আসামি হলেন শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন, সাবেক কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম।
গতকাল তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
এ মামলার আসামি ইমাজ হোসেনের আইনজীবী মো. জিয়াউর রশিদ এবং পলাতক চার আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী কুতুব উদ্দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। পরে পাল্টা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম। আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে দাবি করে চূড়ান্ত যুক্তিতর্কে সব আসামির সর্বোচ্চ সাজা চেয়েছে প্রসিকিউশন।
আর অভিযোগ প্রমাণে প্রসিকিউশন ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে আসামিদের বেকসুর খালাস চেয়েছে আসামিপক্ষ।
গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের দিন রাজধানীর চানখারপুলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ৬ আন্দোলনকারী। তাঁরা হলেন- শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া।
এই ঘটনায় অভিযোগ দাখিলের পর ৬ মাস ১৩ দিনে তদন্ত শেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। গত ২০ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় সংস্থাটি।
এটিই ছিল জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন। পরে গত ২৫ মে এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেন। এ মামলায় ৭৯ জনকে সাক্ষী করেছে প্রসিকিউশন। পরে গত ১৪ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
এরপর ১১ আগস্ট চিফ প্রসিকিউটরের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্যদিয়ে এই মামলার বিচার শুরু হয়। ওই দিন শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ। ২৩ কার্যদিবসে ২৬ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। আসামিপক্ষে সাফাই সাক্ষী দিয়েছেন দুইজন। গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে এ মামলায় যুক্তিতর্ক শুরু করে প্রসিকিউশন। আসামিপক্ষ শুরু করে গত ২২ ডিসেম্বর থেকে। গতকাল উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে রায়ের তারিখ ধার্য করে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় ঘটনাস্থল হতে আলামত হিসেবে জব্দ করা ফায়ার কার্তুজ ও ফায়ার বুলেট সদৃশ বস্তুর ব্যালিস্টিক পরীক্ষা করে বিস্তারিত মতামত প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত।
আজ বুধবার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আওলাদ হোসাইন মোহাম্মদ জুনায়েদ এ আদেশ দেন।
আবেদনে বলা হয়েছে, মামলার ভিকটিম শরিফ ওসমান হাদি ওরফে ওসমান গণি (৩৩) গত ১২ ডিসেম্বর বেলা দুপুর আনুমানিক ২টা ২০ মিনিটের দিকে পল্টন থানাধীন বিজয়নগর বক্স কালভার্ট রোড সংলগ্ন ডিআর টাওয়ারের সামনে দুষ্কৃতিকারীদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরবর্তীতে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স যোগে গত ১৫ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে নিয়ে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় গত ১৮ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃতদেহ বাংলাদেশ বিমান যোগে দেশে এনে ২০ ডিসেম্বর সকালে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়।
উক্ত মমলায় ঘটনাস্থল হতে ফায়ার কার্তুজ ও ফায়ার বুলেট সদৃশ বস্তু আলামত জব্দ করা হয়। মামলাটির সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আলামতসমূহ ব্যালিস্টিক পরীক্ষা করে বিস্তারিত মতামত প্রদান করার জন্য সিআইডির ব্যালিস্টিক শাখার বিশেষ পুলিশ সুপারকে নির্দেশ প্রদান করা একান্ত প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর দুপুর আনুমানিক ২টা ২০ মিনিটে পল্টন থানাধীন বক্স কালভার্ট রোডে ওসমান হাদির ওপর দুষ্কৃতিকারীরা গুলি করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় গত ১৪ ডিসেম্বর ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের বাদী হয়ে পল্টন থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ১২০(বি)/৩২৬/৩০৭/১০৯/৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। এরপর গত ২০ ডিসেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা (হত্যা) সংযোজনের আদেশ দেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সিদ্দিক আজাদ।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত ১২ ডিসেম্বর দুপুর আনুমানিক ২টা ২০ মিনিটে মতিঝিল মসজিদ থেকে জুমার নামাজের পর প্রচারণা শেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যাওয়ার পথে পল্টন থানাধীন বক্স কালভার্ট রোডের পাকা রাস্তার ওপর শরিফ ওসমান হাদির পেছন থেকে অনুসরণ করে আসা মোটরসাইকেলে থাকা আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ রাহুল দাউদ ও তার সহযোগী অজ্ঞাতনামা আসামি ওসমান হাদিকে চলন্ত অবস্থায় হত্যার উদ্দেশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করে পালিয়ে যায়।
আহত শরিফ ওসমান হাদিকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরবর্তীতে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সযোগে সিঙ্গাপুর নিয়ে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে গত ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি মারা যান।




