বাংলাদেশের হাসপাতাল ও কমিউনিটিতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর ভয়াবহ বিস্তার ঘটছে। আইসিডিডিআর,বি-র নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, নবজাতক থেকে প্রাপ্তবয়স্ক— সবার দেহেই উচ্চমাত্রায় প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। বিশেষ করে নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি শিশুদের ৮১ শতাংশের শরীরে শনাক্ত হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অগ্রাধিকারভুক্ত মারাত্মক জীবাণু কার্বাপেনেম-প্রতিরোধী ক্ল্যাবসিয়েলা নিউমোনি (সিআর-কেপিএন)।
বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর মহাখালীর আইসিডিডিআর,বিতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বাংলাদেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মোকাবিলা : আর্চ গবেষণার ফলাফল- শীর্ষক গবেষণার ফল তুলে ধরা হয়। আইসিডিডিআর,বি-র অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স ইউনিটের প্রধান ও সহযোগী বিজ্ঞানী ড. ফাহমিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে এ গবেষণা পরিচালিত হয়।
গবেষণাটি ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি), দ্য টাস্ক ফোর্স ফর গ্লোবাল হেলথ (টিএফজিএইচ) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহায়তায় সম্পন্ন হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি ৪২৩ শিশুর মধ্যে ৮১ শতাংশের দেহে সিআর-কেপিএন জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় পার করার পর এ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়। গবেষকরা বলছেন, বিষয়টি স্পষ্টভাবে হাসপাতাল থেকেই সংক্রমণ ছড়ানোর প্রমাণ।
শুধু নবজাতক নয়, প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের অবস্থাও ভয়াবহ। আইসিইউতে ভর্তি ৬০ শতাংশ রোগীর শরীরে সিআরই পাওয়া গেছে। এসব কলোনাইজড রোগীর সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি, একইসঙ্গে হাসপাতালে দীর্ঘ সময় কাটানোর প্রবণতাও বেড়ে যায়।
২০১৯ সালে শুরু হওয়া আর্চ গবেষণার প্রথম ধাপে সুস্থ মানুষ ও হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের দেহে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর ব্যাপক উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। সুস্থ কমিউনিটি সদস্যদের মধ্যে ৭৮ শতাংশ এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৮২ শতাংশের শরীরে এক্সটেন্ডেড-স্পেকট্রাম সেফালোস্পোরিন-প্রতিরোধী এন্টারোব্যাকটেরিয়ালস (ইএসসিআরইই) ছিল। এছাড়া, হাসপাতালে ভর্তি ৩৭ শতাংশ এবং কমিউনিটির ৯ শতাংশ মানুষের শরীরে কার্বাপেনেম-প্রতিরোধী এন্টারোব্যাকটেরিয়ালস শনাক্ত হয়। কলিস্টিন-প্রতিরোধী জীবাণু কমিউনিটির ১১ শতাংশ ও হাসপাতালের ৭ শতাংশ মানুষের মধ্যে পাওয়া যায়। প্রতি পাঁচজনের একজন অংশগ্রহণকারীর শরীরে মেথিসিলিন-প্রতিরোধী স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস (এমআরএসএ) শনাক্ত হয়েছে।
শিশুদের ক্ষেত্রেও গবেষণার ফল উদ্বেগ বাড়িয়েছে। জন্মের প্রথম বছরেই প্রায় ৪০ শতাংশ শিশুর শরীরে সিআরই এবং ৯০ শতাংশের দেহে ইএসসিআরইই-এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিশেষ করে যেসব শিশু জন্মের পর ৭২ ঘণ্টার বেশি হাসপাতালে ছিল, তাদের ঝুঁকি সর্বাধিক। আরও দেখা যায়, এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৮০ শতাংশ শিশু অন্তত একবার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেছে, যা তাদের শরীরের স্বাভাবিক জীবাণুর ভারসাম্য নষ্ট করছে।
তবে পুরো চিত্রের মধ্যে আশার আলোও রয়েছে। গবেষণা বলছে, স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস, হাসপাতালের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ (আইপিসি) ব্যবস্থা জোরদার করলে প্রতিরোধী জীবাণু দ্বারা কলোনাইজেশন ও সংক্রমণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
ড. ফাহমিদা বলেন, সীমিত সম্পদেও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিলে দুর্বল রোগীদের জীবন বাঁচানো যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সিআর-কেপিএন-কে অগ্রাধিকার প্যাথোজেন হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে এর দ্রুত বিস্তার চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চিকিৎসকরা সতর্ক করছেন, প্রতিরোধী জীবাণু এভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকলে বর্তমানের অনেক অ্যান্টিবায়োটিক অচল হয়ে যাবে এবং সাধারণ সংক্রমণও চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে উঠবে।