ক্রিকেটের নয়া হ্যারি পটার

SHARE
harriযা চলে আসছে, সেটা ভেঙে নতুন কিছু করে দেখানোর চেষ্টা সব শিল্পীই করে থাকেন৷ সাহিত্য, ছবি আঁকা, গান-বাজনা, সিনেমা বানানো, সবেতেই এটাই দস্তুর৷ কেউ পারে, কেউ পারে না৷ যারা পারে, তাদের জন্য থাকে ইতিহাসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত৷ আর যারা পারে না, তারা মাঝারিয়ানার গন্ডিতেই রাজ করে৷

খেলাধুলোর দুনিয়াও তুলে ধরে ওই ছবিটাই৷ হৃদপিন্ডের গোপন কুঠুরিতে সব ক্রীড়াবিদের ঠাঁই হয় না৷ হাতে গোণা বিরল প্রজাতির কয়েকজনেরই সেখানে প্রবেশাধিকার থাকে৷ যেমন লিওনেল মেসি৷ যিনি মাত্র হপ্তাখানেক আগে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে বায়ার্ন ম্যাচের রাতে ধূম লাগিয়ে দিয়েছিলেন ফুটবলপ্রেমীর হৃদকমলে! আর এমনই অব্যর্থ লাগিয়ে দিয়েছিলেন যে ম্যাচ হয়ে যাওয়ার চব্বিশ ঘন্টা পরেও আবেশের হ্যাংওভার কাটতেই চাইছিল না৷ অনির্দিষ্ট কালের সম্মোহনে বেঁধে রাখছিল মনকে৷

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালের সঙ্গে একটা আইপিএল ম্যাচের তুলনা করলে মহান খেলা ক্রিকেটকেই ছোট করা হয়৷ সেটা অবশ্যই করছি না৷ কিন্তু এবি-ও সেই বিরল প্রজাতিরই প্রতিনিধি৷ তাই ৫৯ বলে ১৩৩ নট আউটের ম্যাচ শেষ হয়েছে তো কী, এবি-ম্যানিয়া ‘শেষ হয়েও না হইল শেষ!’ গত রাতের মহাভোজের আঘ্রাণ এখনও আবিষ্ট করে রেখেছে ক্রিকেটদুনিয়াকে৷

তাই পাড়ার রক থেকে অভিজাত ক্লাবের সান্ধ্যবাসর, ফেসবুক-টুইটার-গুগল প্লাসের দুনিয়াতেও সংলাপের সিংহভাগ জুড়ে শুধুই এবি৷ ১৩৩ নট আউট বা ৫৯ বল দুটো সংখ্যা মাত্র৷ আসল কথা হল, এবি-র ব্যাটের ঐশ্বরিক জাদুস্পর্শে ক্রিকেট নতুন করে আবিষ্কার করছে ব্যাটসম্যানশিপের নতুন সীমানা৷

এর চেয়েও কমসংখ্যক বলে বছর দুয়েক আগে ক্রিস গেইলের ৬৬ বলে ১৭৫ নট আউট দেখেছে আইপিএল৷ সাত বছর আগে চিন্নাস্বামীতে শিহরণ তোলা ম্যাকালামের ১৫৮-ও দেখেছে৷ গেইল তো আট বছর ধরেই আইপিএলে ছক্কা মেরে চলেছেন৷ ‘জামাইকান জল্লাদ’ কুড়ি-বিশের ফর্ম্যাটে কী করতে পারেন, দুনিয়া জানে৷ কিন্তু ভয়ঙ্কর গেইলও কোনওদিনই ধারাবাহিক ছিলেন না৷ তাই ১০৩ টেস্ট খেলেও তার ব্যাটিং গড় ৪২.১৮ তেই আটকে৷ সেখানে ধারাবাহিকতায় গত পাঁচ বছরে ক্রিকেটের তিনটে ফর্ম্যাটেই যে ধারাবাহিকতা এবি দেখিয়েছেন, তা এক কথায় আধুনিক ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যানোচিত৷

মাত্র ১৬ বলে ওয়ান ডে হাফ সেঞ্চুরি ও ৩১ বলে সেঞ্চুরির বিশ্বরেকর্ড বা টেস্ট ও ওয়ান ডে র্যাঙ্কিংয়ে দীর্ঘকাল এক নম্বরে থেকে যাওয়া (এখন অবশ্য টেস্টে সঙ্গকারার পরে দুই, ওয়ান ডে-তে এক) একটা শুকনো পরিসংখ্যান মাত্র৷ আরও চমকপ্রদ, গত পাঁচ বছরে টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এবি-র গড় ৫৪.৪২, নিউ জিল্যান্ড, ভারত ও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেটা যথাক্রমে ৪৮, ৪১.৭২ ও ৪১.২৮৷ সেটাই আবার ওয়ান ডে-তে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৯৪, নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৩৭, ভারতের বিরুদ্ধে ৫৮, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩৯৷ একমাত্র ইংল্যান্ড বাদ দিলে সব ক’টা নামী টেস্ট বা ওয়ান ডে খেলিয়ে দেশগুলোর বিরুদ্ধে অভাবনীয় সাফল্য৷ এখন পর্যন্ত ৯৮ টেস্টে ব্যাটিং গড় ৫২.০৯, ১৮৭ ওয়ান ডে-তে অবিশ্বাস্য ৫৩.৬৫! সব ধরনের উইকেটে, সব ধরনের পরিবেশে বিশ্ব ক্রিকেটের সফলতম ব্যাট৷

আরও দুই গ্রেটকে দেখুন৷ শচিন টেন্ডুলকার এবং কুমার সাঙ্গাকারা৷ শচিনের টেস্ট ব্যাটিং গড় যেখানে ৫৩.৭৮, সেটাই ওয়ান ডে-তে কিন্তু ৪৪.৮৩৷ সাঙ্গাকারার টেস্ট গড় যেখানে ৫৯ ছুঁইছুঁই, সেটাই ওয়ান ডে-তে ৪২ পেরোয়নি৷ এবি-র বয়স এখন ৩১, ধরেই নিচ্ছি কম করে আরও পাঁচটা বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে থাকবেন৷ সে ক্ষেত্রে কোথায় থামবেন তিনি? সাধে প্রোটিয়া টিমমেট ডেল স্টেইন তাকে ‘ম্যাট্রিক্স’ ছবির নিও বলছেন?

মার্টিন ক্রো বিশ্বকাপের আগে ব্যাটিং ও আধুনিক ব্যাটসম্যানশিপ নিয়ে একটা লেখার শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘মাইন্ড দ্য গ্যাপ’৷ বিলেতের পাতাল রেলের প্রতিটি স্টেশনে যা প্লাটফর্মের উপর লেখা থাকে আর পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ঘোষিত হয়৷ ক্রো বলতে চেয়েছিলেন, প্রতিটা বল হয়ে যাওয়ার পরে বল সরাসরি ফিল্ডারের হাতে গেলেও স্টান্স নিয়ে পরের বলটা খেলার আগে যে কোনও ব্যাটসম্যান গড়ে ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ড পেয়ে থাকে৷ মোদ্দা কথা, খেলাটা চলমান নয় বলে ব্যাটসম্যান তার মস্তিষ্কের ধূসর কোষে সঙ্কেত পাঠাতে পারে বা ভাবতে পারে, ফিল্ড অনুযায়ী পরের বলটা কী ভাবে খেলবে৷ কে কী ভাবে এই ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের গ্যাপটা কত ভালো ভাবে কাজে লাগাচ্ছে বা নিজেকে কতটা বদলে নিতে পারছে, সে তত গ্রেট ব্যাট৷

এই ‘মাইন্ড দ্য গ্যাপ’-এর মধ্যে থাকছে থট রিডিং৷ মানে বোলারের চোখ ও হাত দেখে আগে থেকে সে কী করতে যাচ্ছে সেটা ভেবে নিয়ে মিলিয়ে দেওয়া৷ এটাই সফল ভাবে দিনের পর দিন করে চলেছেন এবি৷ লেগ বা মিডল স্টাম্প গার্ড নেওয়ার ব্যাপারটাই তার জন্য অবলুপ্তির পথে৷ কখনও লেগে সরে আসছেন, কখনও সাফল করে অফে৷ টি-টোয়েন্টি ফর্ম্যাটে ডেথ-এ বিশ্বের এক নম্বর বোলার এখনও মালিঙ্গা৷ ঢাকায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে ধোনিকে পর্যন্ত মারতে দেননি৷ সেই তিনিও দেখলেন, নিখুঁত ইয়র্কার ব্যাটসম্যান ক্রিজের ডেপথ ব্যবহার করে অবলীলায় স্কোয়ার লেগ বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে দিচ্ছে৷ পরপর দুটো বল মিড উইকেট বা স্কোয়ার লেগ দিয়ে উড়ে যাওয়ার পর যেই ফিল্ডিং টিমের ক্যাপ্টেন লেগে বাড়তি লোক আনবেন, সঙ্গে সঙ্গে এবি-র অ্যাটাক ঘুরে যাবে অফের দিকে৷ মাথার মধ্যে যেন পুরো মাঠটা এঁকে রাখা আছে৷

২০ বলে ৪০ বা শেষ ওভারে ছয় মেরে জেতানোর জন্য রাসেল-পোলার্ড বা রায়াডুরা থাকবেন৷ কিন্তু এরা বড়জোর রাউলিংয়ের গল্পের ‘মাগল’ হতে পারেন, কুড়ি-বিশের বাইরে বেরোলেই কেরামতি শেষ৷ এখানে ‘ক্রিকেটের হ্যারি পটার’ ও-ই একজনই৷

অ্যাব্রাহ্যাম বেঞ্জামিন ডে ভিলিয়ার্স!

সব্যসাচী সরকার: ভারতীয় সাংবাদিক