তারেক রহমান : জুলাই অভ্যুত্থানের নেপথ্যের স্থপতি

SHARE

বাংলাদেশের মাটিতে অনুপস্থিত থাকলেও, লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নেপথ্যে থেকে জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। দূর থেকেই তিনি সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন, সময়োপযোগী কৌশলগত নির্দেশনা দিয়েছেন এবং এমন এক নেতৃত্ব প্রদান করেছেন যা ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। তার লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট—গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল ধ্বংসকারী একটি শাসনব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলা এবং জনগণের কণ্ঠস্বর পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি গণঅভ্যুত্থানের সূত্রপাত করা।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবার দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় অন্যায়ভাবে কারাবরণ করেছেন, আর তার বড় ছেলে তারেক রহমান, স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান ও কন্যা জায়মা রহমান এখনো নির্বাসনে আছেন। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো দুঃখজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। এই রাজনৈতিক পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিহিংসার লক্ষ্যবস্তু হয়ে আছে।

গত প্রায় ১৫ বছর ধরে, প্রথমে খালেদা জিয়া ও পরবর্তীতে তারেক রহমানের নেতৃত্বে, বিএনপি এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তি শেখ হাসিনার শ্বাসরুদ্ধকারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
এই দীর্ঘ প্রতিরোধ একসময় রূপ নেয় একটি গণআন্দোলনে, যার সর্বশেষ রূপ দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে পরিচালিত কোটা সংস্কার আন্দোলনে। শুরুতে এটি ছিল কেবলমাত্র ছাত্রদের অসন্তোষ, কিন্তু পরবর্তীতে তা রূপ নেয় জাতীয় গণঅভ্যুত্থানে—যার নেপথ্যে ছিল তারেক রহমানের দূরদর্শী কৌশল।

২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর, বিএনপি দশ দফা দাবির ভিত্তিতে একযোগে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। এরপর ২০২৩ সালের ১২ জুলাই থেকে দলটি এক দফা দাবিতে নেমে আসে—শেখ হাসিনার পদত্যাগ।
এই আন্দোলনে ৪০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়, যা বর্তমান শাসনব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের গভীর অসন্তোষকে তুলে ধরে।

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। এই দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে লক্ষাধিক মানুষ রাজপথে নেমে আসে নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য। এরই মাঝে হাজার হাজার বিএনপি নেতা-কর্মী গুম, অপহরণ ও রাষ্ট্রীয় হত্যার শিকার হয়েছেন। ৫০,০০০-এরও বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা করা হয়েছে এবং বহু মানুষ এখনো কারাবন্দি।

নির্বাসনে থেকেও তারেক রহমান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো—রেজিস্ট্রিকৃত ও অরেজিস্ট্রিকৃত উভয়কে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, ১২তম সংসদ নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন এবং স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি নিয়মিতভাবে দলীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন, কৌশলগত ও লজিস্টিক সহযোগিতা দিয়েছেন এবং আন্দোলনের গতি থেমে না যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন।

সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের সময়, তারেক রহমান বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান যেন তারা ছাত্রদের পাশে দাঁড়ায়—চুপিচুপি, ব্যানার ছাড়া। তার বার্তাটি ছিল সহজ কিন্তু গভীর: এটা শুধুই বিএনপির আন্দোলন নয়, এটা পুরো জাতির জাগরণ।

বিএনপি কেন্দ্রীয় দপ্তরের তথ্যমতে, জুলাই অভ্যুত্থানে বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের মোট ৭৩৪ জন সদস্য শহীদ হয়েছেন—এর মধ্যে ৪২৩ জন ছিলেন বিএনপির এবং ১৪৪ জন ছাত্রদলের সদস্য। এই সংখ্যাগুলো যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত করা হয়েছে এবং প্রতিটি শহীদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন তারেক রহমান।

বিএনপি নেতারা জানান, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পেছনে তারেক রহমান কখনোই নিজের বা দলের কৃতিত্ব দাবি করেননি। বরং তার লক্ষ্য ছিল স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে একটি যুব-নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনকে জাতীয় বিপ্লবে রূপান্তরিত করা। আন্দোলনের শুরু হওয়ার অনেক আগেই তিনি সতর্ক করেছিলেন: ‘শেখ হাসিনাকে স্বেচ্ছায় সরে যেতে হবে, নইলে গণবিস্ফোরণের মুখোমুখি হতে হবে। এবং বাস্তবেই, এই অভ্যুত্থানের প্রকৃত রূপকার ছিলেন তারেক রহমান—যিনি ছাত্রদের হতাশাকে পরিণত করেছিলেন একটি সমন্বিত জাতীয় আন্দোলনে। তবে নিজের প্রচারের চেয়ে তিনি বরাবরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন ছাত্রদের সাহস ও নেতৃত্বের ভূমিকাকে।’

শারীরিকভাবে দূরে থাকলেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকের মাধ্যমে তিনি নিয়মিত বার্তা দিয়েছেন এবং বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তুলেছেন।

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই, তিনি লেখেন: ‘দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর জন্য আমি মর্মাহত ও শোকাহত, যেখানে আওয়ামী লীগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা নিয়োজিত গুলি ও চাপাতি-ধারীদের আক্রমণে অন্তত ৬ জন ছাত্র নিহত এবং হাজার হাজার আহত হয়েছেন—আওয়ামী লীগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা নিয়োজিত গুলি ও চাপাতি-ধারীদের আক্রমণে। এই সাহসী শিক্ষার্থীরা কেবলমাত্র ৫৬% কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চাচ্ছেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা হাসিনা সরকার আবারও প্রমাণ করলো যে, তারা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সহ্য করতে পারে না—বিরোধিতার তো প্রশ্নই আসে না।’

১৭ জুলাই, তিনি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান, ‘আমাদের সন্তানদের পাশে দাঁড়ান। তাদের ন্যায্য দাবিতে তাদের সাহস ও সমর্থন দিন।’

১৮ জুলাই, তার সতর্কবার্তা আরো তীব্র হয়, ‘আরেকটি গুলি ছোড়ার আগে থামুন। যদি আপনারা সীমা অতিক্রম করেন, এর পরিণতি আপনাদেরই ভোগ করতে হবে।’

১৯ জুলাই, গ্রেপ্তার ও ব্ল্যাকআউটের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্মম দমন-পীড়ন, ইন্টারনেট বন্ধ, গণগ্রেপ্তার—যার মধ্যে আমাদের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও আছেন—এসব সত্ত্বেও ছাত্ররা পিছিয়ে যায়নি। তাদের পাশে দাঁড়ান, তাদের সমর্থন দিন, আন্দোলন চালিয়ে যান। হাসিনার পতন অনিবার্য।’

২১ জুলাই, তার বার্তা হয় আরো জরুরি, ‘হাসিনার ঘাতক বাহিনী আমাদের সন্তানদের রাস্তায় হত্যা করছে। এখনই সময় সর্বশক্তি দিয়ে রাস্তায় নামার।’

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট, তিনি দেশবাসীর প্রতি হৃদয়বিদারক আহ্বান জানান, ‘প্রিয় দেশবাসী, ছাত্রদের ডাকে সাড়া দিন। যাই কিছু থাকে তা নিয়েই রাস্তায় নামুন। প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। আর সেনাবাহিনীর প্রতি আমার অনুরোধ—আপনারা আপনাদের সম্মান রক্ষা করুন, ব্যারাকে ফিরে যান এবং প্রকৃত দেশপ্রেমের মর্যাদা দিন।’

সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘জুলাই–আগস্টের অভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ কিন্তু গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়—যেখানে প্রতিরোধ, নির্যাতন ও আত্মত্যাগ মিলেমিশে আছে। তার ভাষায়, এ সময়কালে ১,৫০০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান, যার মধ্যে ৪২২ জন ছিলেন বিএনপি সংশ্লিষ্ট। আহত হয়েছেন ৩০,০০০-এর বেশি, যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু।

তিনি এই অধ্যায়কে তুলনা করেন অতীতের তিনটি সংগ্রামের সঙ্গে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ৭ নভেম্বরের স্বাধীনতাবিরোধী আধিপত্যবিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৯০-এর প্রো ডেমোক্রেসি গণ-আন্দোলন।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে। আবারও, নাম না জানা শহীদরা স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন।’

তারেক রহমানের জাতির উদ্দেশ্যে বার্তা স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। ‘এটাই সময় একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার—যেখানে শাসন চলবে ভয় বা বলপ্রয়োগ নয়, ন্যায্যতা, অংশগ্রহণ ও জনগণের ইচ্ছায়। আমাদের শহীদদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে হবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।’

সূত্র : ডেইলি সান।