একজন শীর্ষস্থানীয় মার্কিন কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, রাশিয়া থেকে তেল কিনে ইউক্রেনে মস্কোর যুদ্ধে অর্থায়ন করছে ভারত। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের ওপর চাপ বৃদ্ধি করছে, যাতে দেশটি রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে।
হোয়াইট হাউসের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ও ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহকারী স্টিফেন মিলার ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ট্রাম্প যা খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন, তা হলো—ভারতের পক্ষে রাশিয়া থেকে তেল কিনে এই যুদ্ধকে অর্থায়ন করা গ্রহণযোগ্য নয়।’
চীন বাদে ভারত বর্তমানে রাশিয়ার তেলের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ ক্রেতা এবং দেশটির মোট জ্বালানির ৩০ শতাংশেরও বেশি যায় মস্কো থেকে, যা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ক্রেমলিনের জন্য রাজস্বের উল্লেখযোগ্য উৎস হয়ে আছে।
২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে ভারত রাশিয়া থেকে মাত্র ১ শতাংশ তেল আমদানি করত।
মিলারের এই মন্তব্য ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভারতের প্রতি সবচেয়ে কঠোর সমালোচনার একটি। এর আগে শুক্রবার রাশিয়া থেকে অস্ত্র ও জ্বালানি কেনার জেরে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। ট্রাম্প প্রশাসন হুমকি দিয়েছে, ভারত যদি রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র কেনা চালিয়ে যায়, তাহলে আরো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মিলার আরো বলেন, ‘মানুষ বিস্মিত হবে এটা শুনে যে রাশিয়ার তেল কেনার ক্ষেত্রে ভারত কার্যত চীনের সমান অবস্থানে রয়েছে। এটি অত্যন্ত বিস্ময়কর একটি তথ্য।’
তবে তিনি এ-ও বলেন, ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্ক ‘অসাধারণ’। গত সপ্তাহে ট্রাম্প যখন এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন, তখন তিনিও ভারতের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বের’ ওপর জোর দেন।
তিনি ৩০ জুলাই তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফরমে লেখেন, ‘যদিও ভারত আমাদের বন্ধু, তবুও দেশটি সব সময় রাশিয়া থেকে অধিকাংশ সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে এবং চীনের পাশাপাশি রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জ্বালানি ক্রেতা, এমন এক সময় যখন সবাই চায় রাশিয়া ইউক্রেনে হত্যা বন্ধ করুক—সব কিছুই খারাপ দিকেই যাচ্ছে!’
ট্রাম্প আরো বলেন, ‘ভারত রাশিয়ার সঙ্গে কী করে আমি তাতে আগ্রহী নই। তারা চাইলে একসঙ্গে তাদের মৃতপ্রায় অর্থনীতি ধ্বংস করুক, আমার কিছু যায় আসে না।’
ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, যেসব দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছে, তাদের আমদানির ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে, যদি না মস্কো ইউক্রেনের সঙ্গে বড় ধরনের শান্তি চুক্তিতে পৌঁছয়। তিনি ভারতের সমালোচনা করেছেন ব্রিকস জোটের সদস্য হওয়ার জন্যও, যার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রাশিয়া ও চীন।
কিছু বিশ্লেষক বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এই কঠোর অবস্থান হয়তো রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়াতে নেওয়া হয়েছে, আবার কেউ কেউ মনে করছেন, এটি ওয়াশিংটনের শর্ত মেনে চলতে নয়াদিল্লির ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল।
কারণ দুই দেশ বর্তমানে বাণিজ্য আলোচনায় যুক্ত। ট্রাম্প ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চান।
‘সময়-পরীক্ষিত সম্পর্ক’
এদিকে শনিবার রয়টার্সকে দেওয়া মন্তব্যে ভারতের সরকারি সূত্রগুলো বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি সত্ত্বেও মস্কো থেকে তেল কেনা চালিয়ে যাবে নয়াদিল্লি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ‘স্থিতিশীল ও সময়-পরীক্ষিত’ এবং তা কোনো তৃতীয় দেশের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করা উচিত নয়। এই সম্পর্কের ভিত্তি সোভিয়েত যুগ থেকেই।
রাশিয়া ভারতের শীর্ষস্থানীয় তেল ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহকারী। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপরি) মার্চ মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া এখনো ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি গত বছর মস্কো সফর করে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে পুতিনের সঙ্গে আরো একাধিকবার দেখা করেছেন, যেখানে পশ্চিমাবিশ্বের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছে নয়াদিল্লি।
ইতিহাসগতভাবে ভারত মধ্যপ্রাচ্য থেকে বেশি তেল আমদানি করত, তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর ভারত মূল্যছাড়ে রাশিয়ার তেল কিনতে শুরু করে। তখন পশ্চিমারা রাশিয়াকে বর্জন করেছিল। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ভারত রাশিয়া থেকে প্রতিদিন ৬৮ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত তেল আমদানি করত। ওই বছরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১.২ লাখ ব্যারেলে। ২০২৩ সালের মে মাসে এই হার সর্বোচ্চ ২১.৫ লাখ ব্যারেলে পৌঁছয় এবং পরে ওঠানামা করতে থাকে।
এক পর্যায়ে রাশিয়ার তেল ভারতের মোট আমদানির প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছয়, যা মস্কোকে ভারতের প্রধান তেল সরবরাহকারী করে তোলে। প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া কেপলার নামের ডেটা অ্যানালিটিক্স সংস্থার তথ্য উদ্ধৃত করে এ তথ্য জানিয়েছে। অন্যদিকে ভারত বলেছে, রাশিয়া থেকে তাদের আমদানি আন্তর্জাতিক আইনসংগত এবং এটি বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করেছে।