দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তে তেমন কোনো উত্তেজনা না থাকলেও গত সপ্তাহে দু’দেশের সীমান্ত উত্তেজনা নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে বাংলাদেশকে। এই পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী এই দেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা এবং নিজ জলসীমায় যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনসহ দ্বিপক্ষীয় কয়েকটি বিষয় নিয়ে সঙ্কট আরো ঘনীভূত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সুবেদার নায়েক মিজানুর রহমানকে হত্যা এবং তার লাশ ফেরত নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে তিক্ত অভিজ্ঞতা আগামী দিনে দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা।
এছাড়া, ১৯৯৯ সাল থেকে আলোচিত বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারকে নিয়ে নতুন জোট (বিসিআইএম) গঠন এবং সর্বশেষ এই চারটি দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপনও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের কারণে আটকে যেতে পারে বলেও মনে করেন তারা।
এ ব্যাপারে বাংলামেইলের সঙ্গে আলাপকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তজার্তিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান বলেন, ‘জাতিগতভাবে বিভাজন জিইয়ে রেখে মিয়ানমার সরকার পরিস্থিতি জটিল করার পাশাপাশি দেশটির মোসলমানদের আরো অনিরাপদ করে দিচ্ছে। এতদিন ভারতের সঙ্গে সীমান্তে সমস্যা থাকলেও মিয়ানমার সীমান্ত ছিল শান্ত।’ হঠাৎ করেই প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ককে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সীমান্তে সম্প্রতি যা ঘটেছে তা অনভিপ্রেত উল্লেখ করে তিনি অভিযোগ করেন, সুবেদার নায়েক মিজানের লাশ ফেরত আনতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা দুর্বল ছিল।
এদিকে ভারতের নির্বাচনের পরপরই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি এবং পরস্পরকে দোষারোপ করা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. আমেনা মোহসীন।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমার সরকারের অস্পষ্ট অবস্থান। দেশটির মোসলমানরা বাঙালি হিসেবে নিবন্ধন নিলে মিয়ানমার সরকার যদি তাদের বৈধতা দেয় তবে সেটি একটি বিষয়। আর যদি এরপরও বৈধতা না দেয় তবে নিবন্ধিত হওয়ায় আর না হওয়ায় সমান কথা। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক
জাতিসংঘের অভিবাসী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের কাছে এ ব্যাখ্যাটি অবশ্যই চাইতে হবে।’
তিনি বলেন, সেখানকার দূতাবাসও বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাতে পারে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে বর্তমানে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত নিয়ে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। যাদের ফিরিয়ে দিতে সরকার জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা চেয়ে আসছে বছরের পর বছর। তবে মিয়ানমারের অনাগ্রহের কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে, দু’দেশের মধ্যে সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে চলতি মাসের ৯ জুন মিয়ানমার যাচ্ছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদের নেতৃত্বে ৩২ সদস্যের প্রতিনিধি দল। দু’দিনব্যাপী মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে বিজিবি মহাপরিচালক গত শনিবার যোগ না দেয়ার কথা বললেও সোমবার সন্ধ্যায় বাংলামেইলকে টেলিফোনে বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতেই পূর্ব ঘোষিত ৯ জুন মিয়ানমার যাচ্ছি। সেখানে মিজানুরের লুটে নেয়া অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে আলোচনা হবে। দু’দেশের মধ্যে বিরাজমান সীমান্ত সঙ্কট যেন আরো ঘনীভূত না হতে পারে সেদিক বিবেচনায় রেখে আলোচনা করবে বাংলাদেশ।’
অন্যদিকে পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বাংলামেইলকে ফোনে বলেন, ‘বর্তমানে মিয়ানমার সীমান্ত খুবই শান্ত অবস্থায় রয়েছে। বিজিবির মহাপরিচালকের মিয়ানমার সফরের পর আগামী ১৮ জুন সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে দু’দেশের মধ্যে নিরাপত্তা, রোহিঙ্গা, বিসিআইএম গঠন বিষয়ে আলোচনা হবে।’
চার দেশের মধ্যে করিডোর স্থাপনে বিসিআইএম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র সচিব আরো বলেন, ‘১৯৯৯ সালে প্রথম সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে বিসিআইএম গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। গত ২ বছর ধরে বিষয়টি নিয়ে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা হবে। আশা করা যাচ্ছে এবারের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমার ইতিবাচক সাড়া দেবে।’
বঙ্গোপসাগরে নিজ জলসীমায় যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েনকে সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে বাংলাদেশের জলসীমায় বিনা অনুমতিতে মিয়ানমারের যুদ্ধ জাহাজ চলে এলে তখন বিষয়টি দেখা যাবে বলে জানান সচিব। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।