‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার…’

SHARE
maa10সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা তুলনাহীন। কিন্তু সন্তানের কাছে মায়ের চাওয়া ক্ষুদ্র। আধুনিক আত্মকেন্দ্রিক বিশ্বেও মায়ের ভালোবাসার তুলনা বিরল। কিন্তু মাঝে মাঝে এ ভালোবাসার ব্যত্যয় ঘটে। মাকে সইতে হয় নানা যন্ত্রনা, কষ্ট আর লাঞ্ছনা। তারপরও মা তাকিয়ে থাকেন সন্তানের দিকে।

সারা দিনের দুষ্টামির পর সন্তান মায়ের কোলে ফেরে। আর মায়ের আদর পাওয়ার জন্য নানা রকম টালবাহানার আশ্রয় নেয়। মাও ছেলের নাড়ি-নক্ষত্র ভালোভাবেই জানেন, বাহানাগুলোও ধরে ফেলতে পারেন নিমিষে। ছেলের মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ভালোবাসার গভীরতাও বুঝিয়ে দেন সঙ্গে সঙ্গে। সবশেষে যদি এই মমতাময়ী মায়ের আবাসস্থল হয় বৃদ্ধাশ্রম!

১০ মাস ১০ দিন পেটে ধারণ করে নিজে খেয়ে-না খেয়ে সন্তানকে বড় করে মা। বড় হওয়ার পরে মাকে চেনে না, মায়ের পরিচয় দিতেও যেন অসহায় বোধ করে। সন্তানের ধারণা, আগের যুগের মা। বর্তমানে তাল মিলাতে পারবেন না। সে ‘কারণে’ তাকে হতে হয় অবহেলার পাত্র। এই দুঃখ কোথায় রাখেন মমতাময়ী মা! বুড়ো হয়ে গেছে মা, সংসারে তার প্রয়োজন ‘ফুরিয়েছে’। তাই শেষ বয়সে তার আশ্রয় মিলেছে বৃদ্ধাশ্রমে।

নচিকেতা তার গানেই মাকে তুলে ধরেছেন….
ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার
মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার।
নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি
সবচেয়ে কমদামি ছিলাম একমাত্র আমি।
ছেলের আমার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।।

আমার ব্যবহারের সেই আলমারি আর আয়না
ওসব নাকি বেশ পুরনো, ফ্ল্যাটে রাখা যায় না।
ওর বাবার ছবি, ঘড়ি-ছড়ি, বিদেয় হলো তাড়াতাড়ি
ছেড়ে দিলো, কাকে খেলো, পোষা বুড়ো ময়না।
স্বামী-স্ত্রী আর আ্যালসেশিয়ান- জায়গা বড়ই কম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।।

নিজের হাতে ভাত খেতে পারতো নাকো খোকা
বলতাম আমি, “না থাকলে কী করবি রে বোকা?”
ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদত খোকা আমার কথা শুনে
খোকা বোধ হয় আর কাঁদে না, নেই বুঝি আর মনে।
ছোট্টবেলায় স্বপ্ন দেখে উঠত খোকা কেঁদে
দু’হাত দিয়ে বুকের কাছে রেখে দিতাম বেঁধে
দুহাত আজো খোঁজে, ভুলে যায় যে একদম
আমার ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম।।

তারপরেও বৃদ্ধাশ্রমে মা পথের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলেন সন্তানকে একপলক দেখার জন্য। কিন্তু বছরে একবার দেখা হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। তারপরেও মা সন্তানের মঙ্গল কামনায় থাকেন সারাক্ষণ।

মায়ের ভালোবাসার ছোট্ট এক দৃষ্টান্ত- আনুমানিক সালটা ২০০৪ কি ২০০৫ হবে। বৈশাখ মাস। পাথরঘাটার নলীতে এক লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটল। সেখানে কয়েকশ মানুষ নদীতে ডুবে মারা যায়। ঘটনার একদিন পরে সন্তানকে আঁকড়ে ধরা অবস্থায় দুটি মৃতদেহ ভেসে ওঠে। সেখানে মা তার সন্তানকে ওপরে উঁচিয়ে রেখেছে যাতে সন্তান ভালো থাকে। মা ও সন্তান দুজনই মৃত ভেসে ওঠে। মা জানেন, তিনি মারা যাচ্ছেন। নিজের জীবন বাঁচাতে সন্তানকে ছেড়ে দিতে পারতেন। মা সন্তানকে ছেড়ে দেননি। এটাই মায়ের ভালোবাসা। এই মৃতদেহের ছবিটি অনেক পত্রিকায়ও এসেছে।

আরেকটি ঘটনা। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গাজীপুরের হোতাপাড়া থেকে পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে মণিপুর বাজার। বাজার থেকে আরো তিন কিলোমিটার ভেতরে নিরিবিলি পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র। সেখানে এক বৃদ্ধা। নাম হামিদা বেগম। ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করেন, “আমার ছেলে আফতাব এসেছে? কোথায় আমার ছেলে?” তিনি বুকভরা কষ্টে বলেন, ছেলের বউয়ের নানামুখী কৌশলে নিজ ঘর থেকে অজানার পথে বেরিয়ে পড়েন। দিনটা ছিল ২০১১ সালের ২৮ অক্টোবর। ওইদিন বিকেলে সাভারের নবীনগরে একটি চায়ের দোকানে বসে কাঁদছিলেন তিনি। ওই এলাকার দুই তরুণ তাকে এখানে নিয়ে আসেন। এরপর থেকে হামিদা এখানেই আছেন।

আবদুল জাহিদ নামে এক ব্যক্তি ১৯৮৭ সালে উত্তরার আজমপুরে এই কেন্দ্রটি স্থাপন করেন। পরে ১৯৯৪ সালে মণিপুরে স্থানান্তর করা হয় এটি। তখন থেকে এখানে শতাধিক বৃদ্ধা থাকছেন।

সেখানে রয়েছেন কুমিল্লার বাঘাওয়ারা গ্রামের মালিনা দে (৭০)। তার দুই ছেলে দুই মেয়ে রয়েছে। এক ছেলে ভারতে থাকেন, অন্যজন মিরপুরে কাপড়ের ব্যবসা করেন। ছেলেরা তাকে দেখভাল না করায় ওঠেন মেয়েদের বাসায়। তারা তাকে রেখে যান বৃদ্ধাশ্রমে।

চট্টগ্রামের জামালখান এলাকার গৌরী সেনগুপ্ত (৭৫)। তার এক ছেলে বড় ব্যবসায়ী। মাকে দিয়ে গেছেন আশ্রমে। কখনো খবর নেন না।