ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের কয়েক জন কেষ্ট-বিষ্টুর সঙ্গে সে দিন কথা হচ্ছিল। এই সংস্থার ভারতীয় প্রতিনিধিরা মনে করেন, এ দেশে শুধু রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা নয়, বিচারব্যবস্থা এবং আমলাতন্ত্রেও বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। এই দু’টি ক্ষেত্রেও দুর্নীতি বিশেষ ভাবে বাসা বেঁধেছে। এই বিষয়ে নাগরিক সমাজকে সচেতন করার জন্য আরও বেশি বেশি সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করা প্রয়োজন। আর এই প্রচার অভিযানকে এক নাগরিক আন্দোলনের পথে নিয়ে যেতে হলে প্রয়োজন সংবাদমাধ্যমের সমর্থন। সংবাদমাধ্যমই দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে সামাজিক অনুঘটক হতে পারে।
ওই কর্তাটিকে বললাম, কিন্তু সংবাদমাধ্যমও কি দুর্নীতি মুক্ত? সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের একাংশের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তার বিচার কে করবে? সঙ্গে সঙ্গে ওই ভদ্রলোক বললেন, ‘‘না না, এখনই মিডিয়াকে আমাদের আক্রমণের লক্ষ্য করতে চাই না। তা হলে আমাদের প্রচারটাই পণ্ড হয়ে যাবে।’’
কিন্তু পুলিশ বা চিকিৎসক দুর্নীতিগ্রস্ত হলে তো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কিন্তু সাংবাদিকদের কথা তো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। কাক নাকি কাকের মাংস খায় না। এমন প্রশ্নেরও সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে বহু বার।
সম্প্রতি ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’ পত্রিকার ২৮ মার্চ, ২০১৫ সংখ্যায় পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা এবং জ্যোতির্ময় চৌধুরীর একটি প্রবন্ধ পড়ে মনে হল, আত্মসমালোচনা শুরু করার সময় এসেছে। প্রবন্ধটির নাম ‘ট্রেডিং প্লেসেস-এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ জার্নালিস্ট অ্যাজ পাওয়ার ব্রোকার্স অ্যান্ড কর্পোরেট এজেন্ট ইন ইন্ডিয়া’।
এই প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে সংবাদপত্র-মাধ্যমে বাণিজ্য এবং সম্পাদকীয় বিভাগের বিভাজন প্রায় ঘুচে যেতে বসেছে। এই দু’টি বিভাগের মাঝখানে এক চীনের প্রাচীর গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ কথা বহু বার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এই কাজটি করা হয় না। অনেক সময় কিছু সাংবাদিক কর্পোরেট সংস্থার এজেন্ট হিসাবে কাজ করেন, অনেক সময় বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংস্থা বা রাজনৈতিক দল বা নেতার ‘মোল’ বা গুপ্তচর হিসাবে কাজ করেন কেউ কেউ। মতাদর্শগত দায়বদ্ধতা নয়, এ হল কায়েমী স্বার্থ।
পরঞ্জয় ও জ্যোর্তিময় তাদের রচনায় বেশ কিছু তথ্য পেশ করেছেন। গত ২০ ফেব্রুয়ারি শান্তুনু শইকিয়া নামে এক সাংবাদিককে পুলিশ গ্রেফতার করে। শান্তুনু তেল ও গ্যাসের শিল্পের জন্য একটি ওয়েবসাইট চালাতেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজে ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রকাশিত সংবাদ জানায় যে, এসার সংস্থা ও শান্তুনুর ই-মেল কথোপকথন থেকে জানা যাচ্ছে কী ভাবে সাংবাদিক কর্পোরেট গোষ্ঠীর কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছেন। এ ব্যাপারে জনস্বার্থ মামলা থেকেই সমস্ত তথ্য বাইরে বেরিয়ে আসে। এসার শিল্পগোষ্ঠীর কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ার অভিযোগে মেইল টুডের সম্পাদক সন্দীপ বামজাই এবং হিন্দুস্থান টাইমসের আর এক সম্পাদক অনুপমা আই রে-কেও ইস্তফা দিতে হয়। তাদের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উঠেছিল তার আর্থিক মূল্য তেমন নয়। বরং নীরা রাডিয়ার টেপে যে সব অভিযোগ উঠেছিল বরখা দত্ত অথবা প্রভু চাওলা, বীর সাংভির মতো প্রবীণ সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে সেগুলি আরও গুরুতর। একটা বিষয় খুব পরিষ্কার, সেটা হল রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকদের সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের কায়েমি স্বার্থের মিথোজীবীতা গড়ে ওঠে। সাংবাদিককে এই লক্ষ্মণরেখাটি মেনে চলতে হয়। তাকে জানতে হয় কখন এই লক্ষ্মণরেখাটি অতিক্রান্ত হয়ে যায়। এসারের নোটের ভিত্তিতে টাইমস নাউয়ের ডেপুটি এডিটর মিনু জৈনকে নোটিস দেওয়া হয়েছে। এনডিটিভি প্রফিট চ্যানেলেও ময়ুরশঙ্কর ঝায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। রাজনেতা ও সাংবাদিকদের মধ্যে অনেক সময় সংঘাত ও তিক্ততা হয়। তখন রাজনেতারা অনেকেই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারও করতে থাকেন। তখন সাংবাদিকরাও অনেক সময় অসহায় হয়ে যান।
আম্বালায় জন্ম কিম ফিলবি (১৯১২-৮৮) সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ১৯৬৩ সালে ‘ডিফেকটেড’ হন এবং তারপর ব্রিটেনে এক উচ্চস্তরের গোয়েন্দা অফিসার হিসাবে বসবাস করতে থাকেন। এই লোকটি ইকনমিস্ট এবং টাইমসের মতো পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন।
পরঞ্জয়ের রচনা সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন, তিনি নিজে একটু বেশি ‘বায়াসড’। সে তর্কে প্রবেশ করা আজকের লেখার বিষয় নয়। কিন্তু এটা বলতে চাই সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের মধ্যে বেনোজল ঢুকলে সে বিষয়েও আত্মসমালোচনা-আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন।
জয়ন্ত ঘোষাল: নয়া দিল্লি ব্যুরো চিফ, আনন্দবাজার পত্রিকা