শিক্ষিত বেকারদের জন্য বড় ধরনের সুসংবাদ। খুলে যাচ্ছে চাকরির দুয়ার। শিগগিরই শিক্ষা খাতে অন্তত ৮৩ হাজার জনবল নিয়োগ করা হচ্ছে। এর মধ্যে আট হাজার জনবল সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ করা হবে। বাকি ৭৫ হাজার নিয়োগ পাবেন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বেসরকারি এই ৭৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীই আবার এমপিওভুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন। পাবেন সরকার থেকে বেতন-ভাতা। সে হিসেবে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এই ৮৩ হাজার জনবলই সরকার থেকে বেতন-ভাতা পাবেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা মিলিয়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে ৫৭ হাজার ৩৪ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। আর এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা-সহায়ক কর্মচারী নিয়োগ পাবেন ২৬ হাজার ৭০৫ জন। এসব নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ বিষয়ে সমকালকে বলেন, ‘শিক্ষা খাতের সব শূন্য পদ পূরণের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে চাইলে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ্য শিক্ষক ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা-সহায়ক জনবল থাকা দরকার।’ তিনি বলেন, দিনের পর দিন পদ শূন্য পড়ে থাকলে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম হোঁচট খেতে থাকে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারি শূন্য পদ পূরণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের আলোকেই শিক্ষা খাতের সব শূন্য পদ পূরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এ নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হলে ‘প্রতি পরিবার থেকে একজন চাকরি’ দেওয়ার সরকারি প্রতিশ্রুতির সিংহভাগই পূরণ হবে। এ নিয়োগ সম্পন্ন করার জন্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির নীতিমালা ও জনবল কাঠামোতে সংশোধনী আনা হচ্ছে। সৃষ্টি করা হচ্ছে নতুন পদ।
জানা গেছে, দেশের ২৭৯টি সরকারি কলেজে বর্তমানে চার হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের এসব পদ পূরণের জন্য প্রয়োজনে বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে চলতি মাসেই পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে (পিএসসি) চিঠি দিতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে ৩১৭টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও দেড় হাজার শিক্ষকের পদ এখন শূন্য। এসব পদের নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণের জন্যও পিএসসিকে পৃথক চিঠি দেওয়া হবে। এ ছাড়া সারাদেশের সব সরকারি স্কুল-কলেজের কর্মচারী পদ বর্তমানে ফাঁকা রয়েছে তিন হাজারের কিছু বেশি।
এর মধ্যে এক হাজার ৯৬৫ জন জনবল নিয়োগের বিষয়টি বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) প্রক্রিয়াধীন। এরই মধ্যে লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মাউশির পরিচালক অধ্যাপক এলিয়াছ হোসেন জানিয়েছেন, বাকি এক হাজার কর্মচারী পদও পূরণের জন্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা তারা পেয়েছেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানে সব মিলিয়ে আট হাজার শিক্ষক-কর্মচারী আগামী জুলাইয়ের আগেই নিয়োগ সম্পন্ন করতে চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও স্মরণকালের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী একসঙ্গে এবার নিয়োগ ও এমপিওভুক্ত হতে যাচ্ছেন। এ জন্য এমপিওর নীতিমালা সংশোধন করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এতে নতুন করে ৭৫ হাজার জনবল এমপিওভুক্ত হতে পারবেন। বর্তমানে প্রতিটি বেসরকারি এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলা, ইংরেজি, সমাজ ও ব্যবসায় শিক্ষা- এ চারটি বিষয়ের বিপরীতে মাত্র তিনজন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে পারেন।
নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও মাউশির উপপরিচালক (মাধ্যমিক) মোস্তফা কামাল সমকালকে বলেন, এমপিওভুক্তির জনবল কাঠামো সংশোধন করে তারা এ চারটি বিষয়ে পৃথক চারজন শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করতে সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছেন। এই নীতিমালা পাস হলে সারাদেশের এমপিওভুক্ত ১২ হাজার ৭০০ বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে একজন করে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ পাবেন। সে হিসাবে ১২ হাজার ৭০০ শিক্ষক একসঙ্গে এমপিওভুক্ত হবেন। নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির অপর সদস্য ও মাউশির উপপরিচালক (বেসরকারি কলেজ) মেজবাহ উদ্দিন সরকার সমকালকে বলেন, কলেজগুলোতে ‘কম্পিউটার ও তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তি’ নামে নতুন বিষয় আবশ্যিক করা হয়েছে।
সারাদেশের দুই হাজার ৩৬১টি বেসরকারি কলেজের প্রতিটিতে একজন করে শিক্ষক এ বিষয়ে এমপিওভুক্ত পদে নিয়োগ পাবেন। তারা হিসাব করে দেখেছেন, ৬৮২টি কলেজে বর্তমানে এ বিষয়ের শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। এমনি করে মাদ্রাসা শিক্ষাস্তরেও আইসিটি ও ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
এমপিওভুক্তির খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে জানা গেছে, নীতিমালা সংশোধিত হলে এমপিওভুক্ত পদে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় নিয়োগ পাবেন মোট ৫১ হাজার ৫৩৪ শিক্ষক ও ২৩ হাজার ৭০৫ এমএলএসএস। এর মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলা, ইংরেজি ও সামাজিক বিজ্ঞানে পৃথকভাবে শিক্ষকের পদ তিনটি হলে যোগ হবে ছয় হাজার ৬৫২ শিক্ষক। মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও চার বিষয়ে চারজন শিক্ষক নিলে যোগ হবে ১২ হাজার ৭৭৩ শিক্ষক।
মাদ্রাসায় একইভাবে এমপিওভুক্তির সুযোগ পাবে সাত হাজার ৬০৬ শিক্ষক। এ ছাড়া সব স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার জন্য তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ের ২৬ হাজার ৬৮ শিক্ষক এমপিওভুক্ত পদে নিয়োগের সুযোগ পাবেন। শিগগিরই এক কর্মশালার মাধ্যমে এ নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে বলে জানা গেছে।
দেশে বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে ২৬ হাজার ৬৮টি। এসব প্রতিষ্ঠানে তিন লাখ ৬০ হাজার ৬৪৮ জন শিক্ষক আছেন। আর কর্মচারী রয়েছেন প্রায় এক লাখ পাঁচ হাজার ৫৭৪ জন। সব মিলিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় চার লাখ ৬৬ হাজার জন। এর সঙ্গে নতুন করে আরও ৭৫ হাজার যুক্ত হবেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরেও সব শূন্য পদ পূরণের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এ অধিদপ্তরের ৩০১টি উপসহকারী প্রকৌশলী পদ শূন্য রয়েছে। শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান ৪ এপ্রিল আইডিইবির ২০তম কাউন্সিল অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তৃতাকালে এসব শূন্য পদ পূরণের জন্য শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীকে নির্দেশ দেন।
শিক্ষা খাতের সব শূন্য পদ পূরণের সরকারি সিদ্ধান্তকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেন, শিক্ষকের পদ শূন্য থাকলে পাঠ দেবেন কারা? আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হতে গেলে জনবলের শূন্যতা দৈনন্দিন কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটায়। সরকারের এ সিদ্ধান্ত খুবই সময়োপযোগী ও দূরদর্শী। পাশাপাশি বেকারত্ব মোচনেও তা অনবদ্য ভূমিকা পালন করবে।