ইতিহাস বলে ‘সকার’, আজ ফুটবল নামে যে খেলাকে আমরা চিনি তার আবিষ্কার বা গোড়াপত্তন হয়েছিল হ্যারো বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ অর্থাৎ, ইংল্যান্ডেই ফুটবল খেলার শুরু বলে ইতিহাস মেনে নিয়েছে৷ কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল, যা কিনা বহুদিন আগে থেকেই অলিম্পিককে পেছনে ফেলে ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে ফরাসি নেতৃত্ব৷ ১৯০৪ সালে যখন সাতটা দেশ নিয়ে ফিফা গঠিত হয় তখন থেকেই শুরু হয় এমন একটি প্রতিযোগিতার পরিকল্পনা, যা আয়োজন করার এক্তিয়ার শুধু ফিফারই থাকবে৷ ১৯২০ সালে ঠিক হয়ে যায় ৪ বছর অম্তর এই টুর্নামেন্ট হবে এবং সেই সভাতেই ফিফার সভাপতি নির্বাচিত হন ফ্রেঞ্চ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন সভাপতি জুলস রিমে৷ শেষ পর্যম্ত দীর্ঘ ২৫ বছরের চেষ্টায় ১৯২৯ সালে ঠিক হয় বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা শুরু হবে ১৯৩০ সালের জুন মাসে, আয়োজক দেশ হবে ১৯২৪ আর ১৯২৮ সালের অলিম্পিকে ফুটবল চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে৷ এই দীর্ঘ ২৫ বছরের প্রয়াসে যারা আম্তরিকভাবে জড়িয়ে ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম জুলস রিমে৷ ফলে সর্বসম্মতিক্রমে বিশ্বকাপ ট্রফির নাম হয় তারই নামে– জুলে রিমে৷ যিনি জুলস রিমেকে এই কাজে দক্ষভাবে সহায়তা করেছিলেন তিনি ইউরোপীয় ফুটবলের তৎকালীন সভাপতি হেনরি ডিলনে৷ এই হেনরি ডিলনেও একজন ফরাসি৷ সুতরাং, যে বিশ্বকাপ ফুটবলের দিকে এই মুহূর্তে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তার পেছনে ফরাসিদের অবদান অনস্বীকার্য৷
ফ্রান্স ফুটবল দল প্রথম বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল পর্যম্ত গিয়েছিল৷ সেই থেকে আজ অবধি বিশ্বকাপ ফুটবলে ফ্রান্স দলের পারফরমেন্স উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়েই এসেছে৷ যদিও কখনই তা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেনি৷ তবে, মাঝে মাঝে এতটাই উচ্চতায় পৌঁছেছে যা ফুটবলপ্রেমীরা ভোলেনি৷ নানা উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে এবং বহু বিবর্তনের পর, যখন জুলে রিমে ট্রফির সেই সোনার পরী চিরকালের জন্য চলে গেছে ব্রাজিলের ট্রফি ক্যাবিনেটে, এবং ফলে, ‘ফিফা কাপ’ নাম হয়েছে ট্রফির, শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে লাতিন আমেরিকার দীর্ঘদিনের একাধিপত্যকে টেক্কা দিয়ে ইউরোপে জোহান ক্রুইফ-বেকেনবাউয়ার-এর আবির্ভাব ঘটেছে, তখনই এল আশির দশক৷ ভারতীয়দের কাছে ৮০-র দশক তাৎপর্যপূর্ণ কারণ, তারা বিশ্বকাপ ফুটবলের সব ম্যাচ টিভিতে দেখার সুযোগ পেতে শুরু করল৷ এই ৮০-র দশকে আর্জেন্টিনা বিশ্ব ফুটবলকে উপহার দিল এমন একজন ফুটবলার যে আমার মতে বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার৷ ঠিক এমনই সময় বিশ্ব ফুটবল আরও উপহার হিসেবে পেল তিন হাফব্যাক সংবলিত আধুনিক ফুটবলের মাঝমাঠের সমন্বয় প্লাতিনি-তিগানা-জিরেসকে৷ আদর করে তখন এদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মিডফিল্ড ট্রায়ো’৷ এই মিডফিল্ড ট্রায়ো যে ফ্রান্সের তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ গোটা ৮০-র দশক জুড়েই প্লাতিনিরা আমাদের মুগ্ধ করে রেখেছিল, কিন্তু ফ্রান্সকে বিশ্বকাপের ফাইনাল পর্যম্তও নিয়ে যেতে পারেনি৷ অবশেষে বিশ্বকাপ জেতার দীর্ঘদিনের পিপাসা মিটল, আমার মতে, বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলার জিনেদিন জিদানের হাত ধরে৷ ’৯৮ সালে দুর্ধর্ষ ব্রাজিলকে পরিষ্কার তিন গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতে ফ্রান্স৷ কিন্তু তার পর থেকে আবার পিছিয়ে পড়া৷ এবার আবার ২০১৪-র বিশ্বকাপে ফ্রান্স কিছুটা সম্ভাবনা নিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে৷ গত তিন বছর ধরে রিবেরি বায়ার্ন মিউনিখ দলকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ট্রফি জিততে সাহায্য করেছে৷ সেই রিবেরির ওপর ভরসা করে এবার ফ্রান্স বিশ্বকাপে ভালো ফল করার আশা করছে৷
ফ্রান্স দলের ডিফেন্স সামলাবে ভারান, এভ্রা, সানারা৷ এদের খেলা আমরা ক্লাব ফুটবলে দেখেছি৷ মাঝমাঠ সামলাতে ক্লেমেম্তে-মাতুইদি-সিসোকোরা৷ এরা মোটেই ৮০-র দশকের ফ্রান্স দলের মাঝমাঠের মতো নয়, এমনকী, এরা এই মুহূর্তে দলের কোচ দেশঁ যে বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক ছিল সে দলের মাঝমাঠের মতোও নয়৷ তবু, দেশঁ-র তত্ত্বাবধানে ভালো খেলবে আশা করা যায়৷ দলের মূল ভরসা ফরোয়ার্ড লাইন, রিবেরি আর বেনজিমা অবশ্যই বিপক্ষকে চিম্তায় রাখবে৷ কিন্তু মূলত ফরোয়ার্ডের ভরসায় ফ্রান্স কতদূর যেতে পারবে তা বোঝার জন্য তো একবার গ্রুপের বিন্যাসের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হয়৷
ফ্রান্স আছে ‘ই’ গ্রুপে, সঙ্গে বাকি তিন দল হল সুইৎজারল্যান্ড, ইকুয়েডর আর হন্ডুরাস৷ আপাতভাবে কেউই ভাবতে পারছে না যে, গ্রুপ পর্যায় থেকেই ছিটকে যেতে হবে ফ্রান্সকে৷ যদিও বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যায়ে যে সব দল যোগত্যার্জন করেছে তাদের কারওকেই ছোট করে দেখা উচিত নয়৷ তবু, মনে হচ্ছে ফ্রান্স গ্রুপ পর্যায় থেকে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে গ্রুপ শীর্ষে থেকেই পৌঁছবে৷ শেষ বেলায় পৌঁছে ফ্রান্সকে কিছুটা অথবা বেশ কিছুটা শক্ত প্রতিপক্ষের সামনে পড়তে হবে বলে মনে হচ্ছে৷ কারণ, প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ হয় নাইজেরিয়া বা বসনিয়া-হার্জোগোভিনা আর না হয় আর্জেন্টিনা৷ যদি নাইজেরিয়াকে বা বসনিয়াকে পায় তাহলে ফ্রান্সের পক্ষে শেষ আটে পৌঁছনো সম্ভব৷ কিন্তু আর্জেন্টিনার বেশ কিছু ফুটবলার এখন দুরম্ত ফর্মে, ফলে, তাদের হারানো ফ্রান্সের পক্ষে প্রায় অসম্ভব৷ তাই, ফ্রান্স গ্রুপ পর্যায় থেকেই চেষ্টা করবে যাতে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে এড়ানো যায়৷
এবার ফ্রান্স দলের কোচ দেশঁ যে জিদানের সহখেলোয়াড়ই শুধু নয়, ’৯৮ সালের বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স দলের অধিনায়কও বটে৷ কিছুদিন আগে আমরা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে দেখেছি জিদান অতিরিক্ত বেঞ্চকে কতটা উৎসাহিত করতে পারে৷ এখন প্রশ্ন, ফ্রান্স জাতীয় দলের অতিরিক্ত বেঞ্চে আমরা জিদানকে দেখব কিনা! যদি জিদান বেঞ্চে থাকে তাহলে ফ্রান্সের খেলায় তার প্রভাব পড়বে কিনা! তবে তা বড় সাফল্যের জন্য যথেষ্ট বলে মনে হয় না৷