টেস্ট ক্রিকেটকে বদলে দিতে পারে ‘বাজবল ক্রিকেট থিওরি’

SHARE

বাজবল হচ্ছে কোচ ব্রেন্ডান ম্যাককালামের অধীনে ইংল্যান্ডের টেস্ট খেলার একটা দৃষ্টিভঙ্গি, যা খেলাটিকে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও উপভোগ্য করে তুলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ জন্য অ্যাশেজ সিরিজ ২০২৩ এর প্রথম টেস্টে হেরে গেলেও ইংল্যান্ডের ক্রিকেট দল ভূয়সী প্রশংসায় ভাসছে, বৃষ্টিবিঘ্নিত এই টেস্টে জয়ের জন্য নানাবিধ চেষ্টা করেছে ইংল্যান্ড, সেই চেষ্টাগুলো না করলে হয়তো এটা হতো নিষ্প্রাণ এক ড্র।
কিন্তু বাজবল ক্রিকেট মানেই টানটান উত্তেজনা যেখানে জয়ের চেষ্টা করাটাই মূল কথা। ইংল্যান্ডের টেস্ট অধিনায়ক বেন স্টোকস বলেছিলেন, ‘আমরা দর্শকদের জন্য কিছু দিতে চাই, টেস্ট ক্রিকেট যে তথাকথিত রীতিতে আবদ্ধ সেই সেকল ভাঙতে চাই।’
ইংল্যান্ডের ক্রিকেটার জনি বেয়ারস্টো মনে করেন, ‘বাজবল কোনো প্রক্রিয়া না, এটা একটা চিন্তাধারা, যা মূলত ক্রিকেটারদের স্বাধীনতা দেয়’।
টেস্ট ক্রিকেটকে অনেকেই রক্ষণাত্মক ঘরানার খেলা বলে যে তকমা দিয়ে এসেছে এতো বছর ধরে, বেন স্টোকসের অধিনায়কত্বে ও ব্রেন্ডান ম্যাককালামের কোচিংয়ে ইংল্যান্ডের এই দলটা এই প্রথা ভাঙ্গার একটা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
যে কারণে উইকেটে জো রুটের মতো থাকার পরেও টেস্টের প্রথম দিন শেষ হওয়ার বেশ কিছু ওভার আগেই ২ উইকেট হাতে রেখে বেন স্টোকস এজবাস্টনের ড্রেসিং রুম থেকে ডাক দিলেন ইনিংস ডিক্লারেশনের।
এই সিদ্ধান্ত অনেকেরই চোখ কপালে তুলেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তের কারণেই এই ম্যাচে একটা ফল এলো, যা ইংল্যান্ডের পক্ষে না এলে টেস্ট ক্রিকেটের পক্ষে এসেছে বলে মত বিশ্লেষকদের।
‘বাজ’ ব্রেন্ডান ম্যাককালামের ডাকনাম, তার টেস্ট ক্রিকেট খেলানোর এই নয়া তরিকাকে তাই নাম দেয়া হয়েছে বাজবল।
বিবিসির চিফ ক্রিকেট রাইটার স্টেফান শেমলিট লিখেছেন, ‘এরা উদ্ভাবক, হয়তো এরা চিরতরে টেস্ট ক্রিকেটকেই বদলে দিচ্ছে।’

বাজবল যুগের শুরু যেভাবে
গত বছরের মে মাসে ম্যাককালাম ইংল্যান্ডের টেস্ট দলের দায়িত্ব যখন নেন, তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের একজন কোচ কীভাবে টেস্ট ক্রিকেটের দায়িত্ব নেবেন? তাও আবার অভিজাত দল হিসেবে পরিচিত ইংল্যান্ডের।
ম্যাককালাম আইপিএলের দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের কোচ হিসেবে কাজ করতেন এর আগে। ব্রেন্ডান ম্যাককালাম ইংল্যান্ডের কোচ হওয়ার পর একটি টেস্ট সিরিজেও হারেনি দলটি, ম্যাচ হেরেছে গত রাতেরটাসহ মোট ৩টি।
গত বছরের শেষদিকে পাকিস্তান সফরে বেন স্টোকস বলেন, ‘আমি ছেলেদের বলেছি, আমরা বিনোদন জগতে কাজ করি, আমাদের কাজ মানুষকে আনন্দ দেয়া, আমরা চেষ্টা করবো প্রতিটি টেস্ট ম্যাচেই মানুষ যাতে আনন্দ পায় সেটা নিশ্চিত করা।’
এটা কেবল মুখের কথা নয়, ম্যাককালাম-স্টোকস যুগে এই আনন্দ দেয়া— কাজটাই করে আসছে দলটি।
টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে এক ইনিংসে দ্রুততম ৪০০ ও ৫০০ রানের মালিক এখন ইংল্যান্ড।
ইএসপিএন ক্রিকইনফোর প্রতিবেদক অ্যান্ড্রু মিলার প্রথম বাজবল নামটি প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, এরপর থেকে ইংল্যান্ড টেস্ট ক্রিকেট খেলতে নামলেই এই শব্দটি উচ্চারিত ও লিখিত হয়ে আসছে।
‘চাপ সরে গেল, যোগ হলো আনন্দ’
বাজবল ক্রিকেট প্রথম বড় ধাক্কা খেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে লর্ডসে, স্টোকস-ম্যাককালামের কোচ-অধিনায়ক জুটি প্রথমবারের মতো হারের মুখ দেখে, তাও তিন দিনের মধ্যে এবং ইনিংস ব্যবধানে।

স্টোকস বলেন, ‘সেদিন আমি ড্রেসিং রুমে কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি জিগ্যেস করি, তোমরা কেউ গলফ খেলতে চাইলে হাত তোলো।’
‘সবার মধ্যে একটা স্বস্তি নেমে আসে, আমরা হালকা হতে থাকি।’ স্টেফান শেমলিট লিখেছেন, ‘চাপ সরে গেল, যোগ হলো আনন্দ।’
ব্রেন্ডান ম্যাককালাম কীভাবে টেস্ট ক্রিকেটের অনুশীলনের ধরন বদলে দিয়েছেন বিবিসির এই প্রধান ক্রিকেট লেখক তার লেখায় তুলে এনেছেন।
‘স্টোকস ও ম্যাককালামের মধ্যে ছক্কা মারার প্রতিযোগিতা হয়, যে হারবে সে হ্যারি ব্রুককে ডিনার সার্ভ করবে, পেনাল্টি শুটআউটের অনুশীলন হয় এখন, অনুশীলনের সময় ব্রেন্ডান ম্যাককালামের পছন্দের মিউজিক ট্র্যাক বাজতে থাকে, যদিও ম্যাককালামের সংগীতের রুচি নিয়ে সবাই নিশ্চিত নন।’
২০২২ সালের পাকিস্তান সফরের আগে গোটা দল আবুধাবিতে গ্রা প্রি দেখতে গিয়েছিল, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের আগে কোচ ম্যাককালামের দাওয়াতে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল কুইন্সল্যান্ডে, ম্যাককালাম নিজের দেশটা অল্প বিস্তর ঘুরে দেখান লিখেছেন স্টেফান শেমলিট।
পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সফরে মূলত বাজবল তার পূর্ণ রূপ দেখতে পায়, যার পরিপূর্ণতা পায় নিউজিল্যান্ড সফরে।
পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ইংল্যান্ড ১০১ ওভারে ৬৫৭ রান তোল্যে।
এই টেস্টেও ইংল্যান্ড চার সেশন হাতে রেখে ইনিংস ঘোষণা করে দিয়েছিল, রাওয়ালপিন্ডির ডুবতে থাকা সূর্যের আলোতে পাকিস্তানের ১০ উইকেট নিয়ে জয় তুলে নিয়েছিল বাজবল ক্রিকেটাররা।
তৃতীয় টেস্টে ইংল্যান্ড চতুর্থ দিনেই ১৬৭ রানের লক্ষ্য টারা করেছিল মাত্র ২৮ ওভার ব্যাট করে।
বেন স্টোকস তখনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ফল যাই হোক, এই দল খেলার ধরন বদলাবে না, এই অ্যাশেজের প্রথম ম্যাচেও তার প্রমাণ মিলেছে।
এই ম্যাচেও হারের পর ইংল্যান্ডের অধিনায়ক বলেন, ‘আমরা ফল নির্ভর দল নই, আমরা অস্ট্রেলিয়াকে সাধুবাদ জানাই কিন্তু আরও ম্যাচ বাকি আছে। আবেগের উত্থান পতন ছিল চরমে, এটাই খেলাটি থেকে আমাদের পাওয়া, একারণে আমরা খেলে যাই।’
অ্যাশেজের প্রথম টেস্টে শেষ ইনিংসে ২৮১ রান তাড়া করে জয় তুলে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ২ উইকেটের ব্যবধানে এই জয়ে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট অধিনায়ক প্যাট কামিন্স আট নম্বরে নেমে ৪৪ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছেন, ম্যাচ সেরা হয়েছেন প্রথম ইনিংসে শতক ও দ্বিতীয় ইনিংসে অর্ধ শতক হাঁকানো উসমান খাজা।
ম্যাচ শেষে প্রতিপক্ষকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন বেন স্টোকস, ‘আমরা তো ধরে নিয়েছিলাম আর মাত্র এক উইকেট দরকার, কিন্তু আপনি কখনোই অস্ট্রেলিয়াকে বাতিলের খাতায় ফেলতে পারেন না।’
ইংল্যান্ড টেস্ট অধিনায়ক মনে করেন, গোটা ম্যাচ নিয়ন্ত্রণে থাকার পর হেরে যাওয়াটা কষ্টের কিন্তু দল আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
সূত্র : বিবিসি