চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা না ঘটলেও নতুন এক কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। বাজার থেকে কেনা গাইড বই থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্ন হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এ পরীক্ষা হয়। এরই মধ্যে এ বিষয়ের খাতা মূল্যায়নের কাজও শেষের পথে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, এ ঘটনা প্রশ্নপত্র ফাঁসের চেয়েও গুরুতর। প্রশ্নপত্র কারা ফাঁস করছে, তা হয়তো ধরা সম্ভব নাও হতে পারে; কিন্তু কারা গাইড বই থেকে পরীক্ষায় প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন, সেটি নিশ্চয়ই বের করা সম্ভব। এ কাজটিই সরকার এবার করে দেখাক।
বৃহস্পতিবার এ নিয়ে সমকালের সঙ্গে আলাপকালে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, অভিযোগটি তিনি এই প্রথম শুনলেন। কেউ লিখিত কোনো অভিযোগও করেনি। তবে তদন্ত করে দেখবেন। জানা গেছে, পদার্থবিজ্ঞানের ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্ন ‘পাঞ্জেরী গাইড বই’ থেকে নেওয়া হয়েছে। অথচ এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন কোনো গাইড বই থেকে নেওয়া সম্পূর্ণ অবৈধ। কারিকুলাম ও সিলেবাস অনুসারে, মূল বই থেকে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে হবে। অথচ এই বোর্ডের পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নপ্রণেতারা পাঞ্জেরী গাইড বই থেকে পদার্থবিজ্ঞানের ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্ন প্রণয়ন করেছেন।বিষয়টি নজরে আসার পর সারাদেশের সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভের ঝড় বইছে। তারা বলছেন, সৃজনশীল পদ্ধতিতে পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্ন প্রণয়ন করতে হয়। গাইড বই থেকে এসএসসিতে প্রশ্ন তুলে দিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা প্রমাণ করলেন, তারা নিজেরাও সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়নে পারদর্শী নন।এ বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি সরব হয়েছেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি গত সোমবার সব গণমাধ্যমের সম্পাদকদের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন, ‘সম্প্রতি পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দেওয়ার একটি বিষয় ঘটতে শুরু করেছে। এক অর্থে এই বিষয়টি প্রশ্ন ফাঁস থেকেও গুরুতর। এর আগে ১৩ মার্চ তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্রে কলাম লিখে বিষয়টি সবাইকে জানান।
এ প্রসঙ্গে এসএসসি পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলেন, অভিযোগটি নতুন এবং খুব অভিনব। পরীক্ষার আগে বোর্ড কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন দেখতে পারে না। তবে এ ব্যাপারটি তারা খতিয়ে দেখবেন। আর বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, প্রতিটি বিষয়ে এবার ৮টি শিক্ষা বোর্ডের প্রতিটি থেকে ৪ সেট করে মোট ৩২ সেট প্রশ্ন তৈরি করা হয়েছে। প্রশ্নপ্রণেতা শিক্ষকরা প্রশ্ন তৈরি করে মডারেটরের কাছে পাঠান। মডারেটর সেখান থেকে প্রশ্ন বাছাই করে লটারি করেন। লটারিতে যে সেটের প্রশ্ন ওঠে সে প্রশ্নই বিজি প্রেসে পাঠানো হয় ও সেখানে ছাপা শেষে পরীক্ষা কেন্দ্রে যায়। তাই তারা বলতে পারছেন না কোন শিক্ষক এই কাজটি করেছেন। তিনি বলেন, হাতে লেখা মূল প্রশ্নপত্র এখন ঢাকার ট্রেজারিতে রাখা আছে। পরীক্ষা চলমান থাকায় এখন তা তারা দেখতে পারবেন না। তবে পরীক্ষা শেষে ট্রেজারি থেকে প্রশ্নের পাণ্ডুলিপি এনে ওই গাইড বইয়ের প্রশ্নের সঙ্গে এসএসসির প্রশ্ন মিলিয়ে দেখবেন। প্রশ্ন মিলে গেলে খুঁজে বের করা হবে সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন প্রণয়নকারী শিক্ষককে। তার পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, শিক্ষকদের সৃজনশীল পদ্ধতিতে নিজে প্রশ্ন তৈরি করার যোগ্যতা অর্জনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর পরও দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষক এখনও সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। বিষয়টি উপলব্ধি করে ২০১২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাজার অথবা গাইড থেকে নমুনা প্রশ্ন নিয়ে পাবলিক কিংবা স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্ন করা যাবে না। তবে বাস্তবে এ নির্দেশনার তোয়াক্কা করছেন না শিক্ষকরা।
পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নপ্রণেতারা শনাক্ত না হওয়ায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল হাসান শায়ক সমকালকে বলেন, তারা এ বইটি প্রকাশ করেছিলেন দুই বছর আগে। বইটি প্রকাশ করা হয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের অনুশীলন করার জন্য ‘প্র্যাকটিস বুক’ হিসেবে। যে শিক্ষক এ বই থেকে মূল পরীক্ষার প্রশ্ন হুবহু তুলে দিয়েছেন, তিনি কাজটি সঠিক করেননি।