সেভেরোদনেৎস্ক থেকে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের পশ্চাৎপসরণ বাধ্য করতে রাশিয়াকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। লেগেছে বেশ কয়েক সপ্তাহ সময়। বিপুল পরিমাণে বোমাবর্ষণ, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি এবং তীব্র লড়াইয়ের পর ইউক্রেনের ক্লান্ত সৈন্যরা বিধ্বস্ত শহরটি ছেড়ে চলে গেছে। এ ছাড়া মারিউপোল, মেলিতোপোল, খেরসনসহ বিরাট একটি অংশে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরুর পর নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া রুশ সৈন্যরা কোন কৌশল অবলম্বন করে নিজেদের এগিয়ে নিচ্ছে?
শহরটির প্রায় ৯০ শতাংশ শিল্পকারখানা, ১ লাখ বাসিন্দার ঘরবাড়ি ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। শহর ছেড়ে চলে গেছে বিপুলসংখ্যক সাধারণ নাগরিক। সেভোরোদনেৎস্কের গভর্নর সেরহি গাইদাই বলেছেন, ‘নিজেদের অবস্থান ধরে রেখে শহরটি ধ্বংস করার কোনো মানে হয় না।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়ার এই অগ্রগতি নির্দেশ করছে—রাশিয়া তার প্রথম দিকের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে দ্রুতই অবস্থান সুসংহত করতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা ‘ব্লিৎসক্রিগ রণকৌশল’ বা ত্বরিৎ গতিতে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের ধ্বংস করে দেওয়ার কৌশল অনুসরণ করেছে। এই পদ্ধতিতে সম্মুখসমরের চেয়ে দূর থেকে গোলা-বোমাবর্ষণের পদ্ধতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
রাশিয়ার এক সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘আমাদের সৈন্যরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। তারা জানে তা কীভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়। যদিও এই কৌশলটি ধীর গতির। কিন্তু এতে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি কম হচ্ছে।’
এখানে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে রাশিয়া শুরু থেকেই ইউক্রেনে বিপুল পরিমাণে সৈন্য হারিয়েছে কিংবা সৈন্যসংখ্যা কম দেখিয়েছে। কেন এমনটা করা হয়েছে তার একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন পোল্যান্ডের সমর বিশ্লেষক কনরাড মুজিকা। তিনি বলেছেন, এ ধরনের কৌশল পরিবর্তনের মানে হলো রাশিয়া সৈন্যসংকটে ভুগছে। কিন্তু সৈন্য আসলে কম কি না, তা পশ্চিমা সূত্রগুলো নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে মুজিকা বলেছেন, ‘তাঁরা (রাশিয়া) যে কৌশলই গ্রহণ করুক না কেন তা তাদের জন্য কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।’
মুজিকা আরও বলেন, ‘আমরা জানি না—প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীতে কী ঘটছে। তাঁরাও কি লোকবল হারাচ্ছে না কি?–আমরা জানি না। যদিও তাদের (ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ) বক্তব্য অনুসারে সবকিছুতেই তারা ভালো অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আসলে তেমনটা ঘটছে না!’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কৌশলে রাশিয়া
সেভেরোদনেৎস্কের পতনের অর্থ হলো লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া এবং তার মিত্রদের দখলের বাইরে থাকল আর মাত্র একটি অঞ্চল। প্রতিবেশী লিসিশানস্ক। উঁচু ভূমিতে অবস্থিত সিভেরস্কি দনেৎস নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরটি অবস্থানের কারণেই রাশিয়ার জন্য দখল করা বেশ কঠিন হবে।
ইউক্রেনীয় বিশ্লেষকেরা দাবি করছে, দখলদারত্বের বিপরীতে রাশিয়াকে উচ্চমূল্য দিতে বাধ্য করছে কিয়েভ। তাঁরা বলছেন, রাশিয়া যে লম্বা সময় ধরে সেভেরোদনেৎস্ক দখলের প্রচেষ্টা চালিয়েছে তাতে মস্কোর বিপুল ক্ষতি হয়েছে।
কিয়েভের সমর বিশারদ ওলেকজান্দর মুজিয়েঙ্কো বলেছেন, ‘প্রথমত, কৌশলগত কারণে আমাদের সৈন্যদের পশ্চাদপসরণ করতে হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সেখানে রক্ষা করার মতো কিছুই ছিল না। সেখানে রক্ষা করার মতো কোনো শহর অবশিষ্ট নেই। দ্বিতীয়ত, আমরা চাইনি আমাদের সৈন্যরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ুক। রাশিয়ার সৈন্যরা আর ৩ সপ্তাহ আগে সেভেরোদনেৎস্ক দখল করে নিলে সবকিছু আরও ভয়াবহ হতো।’
মস্কোর এক সমর বিশারদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেভেরোদনেৎস্কের যুদ্ধকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘বিগত কয়েক মাসে রাশিয়া খুব বেশি অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। এই মুহূর্তে রাশিয়ার লক্ষ্য অঞ্চল দখল করা নয় বরং যুদ্ধক্ষেত্রের ক্ষয়ক্ষতি যত বেশি পারা যায় বাড়িয়ে তোলা।’
ওই রুশ বিশ্লেষক আরও বলেছেন, ‘রাশিয়ার কৌশল হলো—প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেওয়া। এবং এই কৌশল অনেকাংশেই কাজ করছে। এরই মধ্যে, ইউক্রেনীয় সৈন্যরা নৈতিকভাবে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন।’
যদি রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে এমন কৌশল চালিয়ে যেতে থাকে তবে যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। কারণ, ইউক্রেন এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা বিভিন্ন ধরনের দূর পাল্লার অস্ত্র হাতে পেয়েছে এবং এই অস্ত্র নিঃসন্দেহে ইউক্রেনের শক্তি বৃদ্ধি করবে।
রাশিয়া এখনো দনবাস অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে বেশ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। ইউক্রেনীয়রা এখনো দনবাসের প্রায় ৪৫ শতাংশেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মধ্যে দারুণভাবে সুরক্ষিত দুটি শহর স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতরস্ক এখনো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে। এই দুই শহরই সেভেরোদনেৎস্কের চেয়ে আকারে বড়। তবে, রাশিয়ার পরবর্তী টার্গেট লিসিশানস্ক শহর। যত দ্রুত সম্ভব এই শহরটি দখল করে নেওয়া যায় সে লক্ষ্যই থাকবে তাদের। তবে শহরটিতে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী নিজেদের অবস্থান সংহত করেছে।
ওলেকজান্দর মুজিয়েঙ্কো বলছেন, ‘লিসিশানস্কে ইউক্রেনীয়দের সতর্ক থাকতে হবে যে—রাশিয়া তাদের দুই এমনকি তিন দিক থেকে আক্রমণ করতে পারে।’ তবে আক্রমণ যে কয় দিক থেকেই করা হোক রাশিয়ার লক্ষ্য থাকবে দ্রুত শহরটি দখলে নেওয়া। এবং তা করতে গিয়ে রাশিয়া সামনে যা পাবে তাকেই দুমড়ে মুচড়ে দেবে। এই কৌশলেই এগিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া।