বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের শীতল সম্পর্কের বরফ মনে হয় গলতে শুরু করেছে। নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের নিয়োগ এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সৌহার্দ্যপূর্ণ সাক্ষাতের খবরে ঢাকার কূটনৈতিক মহলে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। বার্নিকাটের পূর্বসূরি ড্যান ডব্লিউ মজীনার সময় বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে পৌঁছে। সেই শীতল সম্পর্কের মূলে বেশির ভাগ লোক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুকে বড় করে দেখলেও পর্দার অন্তরালে ভূতাত্তি্বক রাজনীতির আরও অনেক বিষয় জড়িত ছিল।
প্রথাগতভাবে মার্কিন মুলুকের ডেমোক্রেটিক দলের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ভালো বলে সবাই ধারণা করেন। অন্যদিকে রিপাবলিকানদের সঙ্গে রয়েছে বিএনপির সখ্য। কাকতালীয় ব্যাপার কিনা জানি না। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল তখন মার্কিন মুলুক এবং ভারতেও তাদের মিত্ররা ক্ষমতায় ছিলেন। ঐতিহ্যের সেই ধারাবাহিকতায় ওবামা সরকারের সঙ্গে প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের পারস্পরিক সম্পর্ক থাকবে চমৎকার- এই ধারণার পুরোপুরি উল্টোটিই ঘটেছে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের শেষ দিন পর্যন্ত।
২০১৫ সালে এসে পরিস্থিতি প্রতিকূল থেকে অনুকূলে আসতে শুরু করে নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগের পর থেকে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এলেন সেই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির নিমন্ত্রণে। ওয়াশিংটনে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের বাইরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। এই সফরের দুটো উল্লেখযোগ্য বিষয় আমি লক্ষ্য করছি। প্রথমত, জন কেরি বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা সানন্দে গ্রহণ করেছেন। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত এক বছরের মধ্যে এই প্রথম যথেষ্ট ভাব ও গাম্ভীর্যের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে মেপে মেপে কথা বলেছেন। সমালোচনা করা যায় কিংবা সন্দেহ করা যায় এমন একটি বাক্যও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে উচ্চারিত হয়নি।
এখন প্রশ্ন হলো, জন কেরি হঠাৎ করেই বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে আগ্রহসহকারে বাংলাদেশে আসার জন্য তোড়জোড় শুরু করলেন কেন। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা তো প্রথম দিন থেকেই বর্তমান সরকারের কড়া সমালোচনা করে আসছিলেন। তারা ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনকে কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণ করতে রাজি নয়। সমঝোতার ভিত্তিতে নতুন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বার বার চাপ প্রয়োগ করে আসছিলেন। এ দেশে বসবাসরত পশ্চিমা লবির লোকজন আশা করত, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা জাতিসংঘের মাধ্যমে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সরকারের বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দেবে। এদিকে গত প্রায় দুই মাস ধরে দেশে হরতাল-অবরোধের নামে চলছে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যা, অগি্নসংযোগ, অরাজকতা। ফলে সরকারি হিসাবে এযাবৎকালে ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। এ অবস্থায় পশ্চিমের এদেশীয় মিত্ররা আশা করেছিলেন মার্কিন মুলুক থেকে ভয়াবহ কোনো বার্তা আসবে। কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে নতুন করে ভাব করতে যাচ্ছে। কূটনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যুক্তরাষ্ট্রের হঠাৎ এই বায়ু পরিবর্তনে ভারি আশ্চর্য হয়ে নানা কার্যকারণের হিসাব মেলানোর চেষ্টা করেছেন। অনেকে আশ্চর্য হলেও জন কেরির আসন্ন বাংলাদেশ সফরের খবরে আমি কিন্তু আশ্চর্য হইনি। সাম্প্রতিককালের মার্কিন অর্থনীতি, আগামীর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে বিরোধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে সীমাহীন গণ্ডগোল ও আইএসের উত্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তার বিরোধের অনেকগুলো দরজা খুব দ্রুত বন্ধ করতে চাচ্ছে। তারা ইতিমধ্যে কিউবার সঙ্গে প্রায় ৬০ বছরের দীর্ঘ বিরোধের নিষ্পত্তি করতে চাচ্ছে এমনকি কিউবার যে দ্বীপগুলো বিশেষ করে গুয়ানতামো বের মতো বিতর্কিত স্থানগুলোর দখল পর্যন্ত হস্তান্তর করতে চাচ্ছে। প্রতিবেশী মেঙ্েিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে। ইরানের সঙ্গে চলে আসা দীর্ঘ ৩৫ বছরের বিরোধও নিষ্পত্তির দ্বারপ্রান্তে। খুব তাড়াতাড়ি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান পরমাণুর ব্যবহার-সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদন করতে যাচ্ছে।
এশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের অতি পুরনো এবং পরীক্ষিত বন্ধু হলো পাকিস্তান। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন না করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে সেই ১৯৫০ সাল থেকে। অনেকবার ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বহুবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু মার্কিন মদদ থাকার কারণে সেনাবাহিনীর গায়ে নূ্যনতম কাঁটার আচড় লাগেনি। অন্যদিকে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন- সেনাবাহিনীর অকুণ্ঠ সমর্থন ও প্রভাবের কারণে মার্কিন নীতি সবসময়ই একই রকম ছিল এবং আছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক ভালো ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এই দুটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চমৎকার একটি সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এ অবস্থায় পুরো এশিয়ার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের সঙ্গে গত ৫-৬ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সরকারিভাবে খারাপ ছিল না- এমনকি রাশিয়ার সঙ্গেও নয়। ইউক্রেন, সিরিয়া এবং ইরান ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে মারাত্দক উত্তেজনা, কূটনৈতিক বাহাস এবং মতদ্বৈধতা সত্ত্বেও দেশ দুটির পররাষ্ট্রনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যান্য আন্তঃমহাদেশীয় সম্পর্ক আছে ঠিক আগের মতো।
এ কথা সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা সবসময়ই গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ থাকে। কিন্তু তাদের যেখানে স্বার্থ আছে সেখানে ওসবের কিছুই দরকার পড়ে না। এমনকি তাদের বন্ধুরা মারাত্দক কোনো অপরাধ করলেও তারা চোখ বুজে থাকে। সাদ্দাম যখন কুর্দি বিদ্রোহীদের ওপর গ্যাস প্রয়োগ করেছিলেন তখন যুক্তরাষ্ট্র কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। অন্যদিকে, ভারত ও পাকিস্তান যখন প্রায় একই সঙ্গে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটাল তখনো তারা মৃদুকণ্ঠে স্বল্পকালীন প্রতিবাদ জানাল। সৌদি আরব, মিসর, সিরিয়া, কুয়েত, জর্ডান এবং লিবিয়াতে তাদের একেক রকম নীতি। আফ্রিকার ব্যাপারে তারা তেমন একটা মাথা ঘামায় না। যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সকে সেখানকার মাতুব্বরি দিয়ে তারা আফ্রিকার ব্যাপারে নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। অন্যদিকে তারা সবসময়ই শক্তের ভক্ত এবং নরমের জমের নীতিতে অটুট থেকেছে। রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, চীন, ভেনেজুয়েলা, কিউবা এবং ইরানের ব্যাপারে বহুবার রণহুঙ্কার ছুড়েছে কিন্তু একটা বুলেট তো দূরের কথা একটা গুলতিও ছোড়েনি। বাংলাদেশের মানুষের দরিদ্রতা, মনমানসিকতা, অভ্যাস এবং ক্ষুদ্র পরিসরের অর্থনীতির জন্য দেশটিকে প্রথম থেকেই যুক্তরাষ্ট্র তাচ্ছিল্য করে আসছিল। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক নেতৃত্বের বহুবিধ দুর্বলতা, অযোগ্যতা এবং সীমাহীন নতজানু নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র গাঙ্গীয় উপত্যকার এই বৃহত্তম দ্বীপ তথা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বদ্বীপ। সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনের দেশ, সবচেয়ে বড় বাঘ ও মিঠা পানির দেশ, সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত, পেশিবহুল মানুষ, স্বল্পভূমিতে, স্বল্প আশঙ্কাসম্পন্ন সুখী মনের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী এবং সবচেয়ে সুন্দরতম আবহাওয়া ও জীববৈচিত্র্যের প্রকৃতিপ্রদত্ত সম্পদকে দৃষ্টিসীমায় আনেনি।
যুক্তরাষ্ট্র তার চিরায়ত স্বভাব বা অভ্যাস মতে বাংলাদেশকে সবসময় নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাবিত করতে চেয়েছে দূর থেকে হুমকি-ধমকি প্রদানের মাধ্যমে। গত ছয়টি বছরে তাদের শত ক্রোধ, হুমকি-ধমকি, প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং দেশ-বিদেশের নানামুখী চাপ ও তাপ প্রয়োগের পরও ক্ষমতাসীন সরকারকে একটুও নতজানু তো দূরের কথা ভয়ও দেখানো যায়নি। অধিকন্তু, সরকার পরিস্থিতি যেভাবে সামাল দিয়েছে তাতে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস, ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দফতর এমনকি হোয়াইট হাউস পর্যন্ত বার বার আশ্চর্য হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত মার্কিন কর্তারা একাধিকবার আক্ষেপ করে বলেছেন, এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে তারা কোনো দেশে কোনো কালে পড়েননি।
বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে গত ছয় বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি এবং মার্কিন মুলুকের আগামীর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে যদি হিসাবের মধ্যে ধরা হয় তাহলে জন কেরির সম্ভাব্য বা আসন্ন বাংলাদেশ সফর এক সুদূরপ্রসারী বার্তা বহন করছে। কূটনীতিবিদরা মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটি নির্ভরতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং পারস্পরিক সম্পর্কের সর্বোচ্চ চূড়ায় নিয়ে যেতে চায়। তারা বাংলাদেশকে তাদের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে পেতে চায় ঠিক জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের সব বাধা অতিক্রম করে সম্পর্কটি এমন একটি মানদণ্ডে উন্নীত করতে চায় যেখান থেকে একে অপরের কাছে অনেক বেশি চাওয়া যায়, পাওয়া যায় এবং আসা করা যায়।
যুক্তরাষ্ট্র জানে যে, আগামী ১০ বছরে তাদের সঙ্গে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের বিরূপ সম্পর্ক হবে? তারা এও জানে যে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কটি হবে সমতার ভিত্তিতে। অন্যদিকে আগামী ৫০ বছরে তাদের জন্য জলে, স্থলে অন্তরীক্ষে সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে চীন-রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া, সে অবস্থায় ভারত মহাসাগরে তাদের দরকার একটু নিরাপদ আশ্রয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিপদ-আপদকালীন পা রাখার একটু জায়গা, যা কিনা বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও সম্ভব নয়। আমি নিশ্চিত কেরি এবং তার সফরসঙ্গীরা একটি পরিবর্তিত মনমানসিকতা এবং ভিন্নমাত্রিক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বাংলাদেশে আসছেন। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা যদি পেশাগত দক্ষতা, আন্তরিকতা এবং সৌজন্যবোধ দ্বারা কেরিকে বরণ করে নিতে পারেন তাহলে আগামীর রাজনীতির সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাবে।
লেখক :